প্রায় তিন মাস বাদে আজ সারাদিন রোদ্দুর। শেষ দুপুরের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে বসে নতুন আসা পুজাবার্ষিকীটার পাতা উল্টোচ্ছিলাম। একটা পাতায় এক মাঠ ভরা সাদা কাশ ফুলের ঢেউ, আর এক পাতায় মা দুর্গার ত্রিনয়নী রূপ।
পরবাসে শরত কাল আমার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, আকাশে সাদা মেঘগুলোর বাড়ি ফেরার পালা। জানলার পর্দায় মাঝে মাঝে খেয়ালি হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছে আর একটা গঙ্গাফড়িং পর্দার ছায়ার সাথে লুকোচুরি খেলছে। দূরে, ঝিলের বুকে তিরতিরে হাওয়া ঢেউ তুলছে মাঝেমাঝে – আকাশটা বর্ষা শেষে বৃষ্টি ধোওয়া, ঝকঝকে নীল।
তেরো বছর হল আমার প্রবাসে, প্রবাসে শরত কাটানোর। এ ক’বছর যে অল্প কয়েকটা দেশে আর শহরে থাকার সুযোগ পেয়েছি, অবাক হয়েছি এই দেখে যে শরতের এই দিনগুলো সবখানেই এক রকম – গাঢ়, সোনালি রোদ, নিবিড় নীল আকাশে সাদা, সাদা পাল তোলা মেঘ – আর এক আনমনা, প্রবাসী বঙ্গবাসিনী। কাজ ফেলে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যায় আকাশপানে, মন টানে দেশপানে, উপড়ে ফেলা শিকড়টা মাটির টানে কাতরায়। আমার মনও দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে, ডায়রির পাতায়, ব্লগের দেওয়ালে শরতচারণ করে। প্রতিবার ভাবি, ‘অনেক তো হল, পরবাসেই যখন ঘর, মন, তুমি এখানেই মন দাও। আর কেঁদো না মাটির টানে’।
কিন্তু আমার প্রবাসী অভিমানী মন জড়িয়ে থাকে শরতের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতির জালে। আমাদের মধ্য কলকাতার পুরানো বাড়ির ছাদের কোণায়, বড় একটা টিনের ড্রামে ছিল একটা শিউলি গাছ। শরতের ভোরে ছাদের ওই কোণাটায় পড়ে থাকত দুধেল সাদা আর কমলা রঙের একটা গালিচা – মুঠোভরে কুড়িয়ে বেড়াতাম শিউলি। শিউলির সেই পরশ এখনও লেগে আছে মুখে, চোখে, চুলে, মনে – মন খুঁজে মরে সেই শিউলি।
আরও স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে, জোর করে মনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি সামনে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে, সামনে মেলে রাখা বইটার পাতায়। কিন্তু দুচোখ ভরা তখন অতীতের ছবি, গন্ধ। আমার ঠাকুমার দেরাজের তাকে রাখা পাটে পাটে ভাঁজ করা, কড়া মাড়ের নতুন তাঁতের শাড়ির থাক; মায়ের নতুন ঢাকাই-এর গন্ধ; পিওর সিল্কের নরম পরশ; রোজ সকালে দুই বোনের ক্যালেন্ডারে দিন গোনা; রোজ সকালে বাবার কাছে পুজাবার্ষিকীর জন্য আব্দার; মা-কাকিমার সঙ্গে পিসি-মাসিদের বাড়ি আলতা-সিঁদুর দিতে যাওয়া। রান্নাঘরে বয়াম ভরা কুঁচো নিমকি, গজা, নারকেল নাড়ু – উফ, মনের সুতোয় টান দিলাম, ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টায়। এবার একটু কড়া গলাতেই বললাম, ‘শিকলি কেটে তো অচিন আকাশে ডানা মেলেছ অনেক দিন, আবার কেন চেনা দাঁড়ের জন্য ঘ্যানঘ্যান?’
মনে তখন ঢাকের বাদ্যি। পাটভাঙা নতুন জামার খুশি, শ্যাম্পু করা উড়ো চুলে এলো বেণি, বুকের ভিতর একটা তিরতিরে কম্পন সবসময়, আনন্দের। অষ্টমীর সকালে অপটু শাড়ির আঁচল টেনে, দুরুদুরু বুকে, আড়চোখে চোখ রাখা হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা আরেক জোড়া চোখে, আর ঈষৎ হেঁসে, চোখ নামিয়ে পালিয়ে যাওয়া। মায়ের সদ্যস্নাত এলো চুলের সিঁথিতে টানা সিঁদুরের রেখা, লাল পাড় গরদের শাড়ি, সোনার চুড়ির ঠুং-ঠাং। আর সন্ধিক্ষণে, সন্ধিপূজার প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় ত্রিনয়নীর ম্রিয়মাণ হয়ে আসা মুখ, ছলছলে চোখ; সিঁদুরে রাঙা বিদায় বেলার উদাস হাসি, ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা।
প্রতি বছর এই সময় শরত আমার দ্বারে এসে আমায় হাঁসায়, কাঁদায়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতির স্রোতে অতীতের ফেলে আসা শরতের দিনগুলোতে। আমার অবুঝ মনের অভিমান কোথায় আমি বুঝি। ফিরে যেতে চায় সে ফেলে আসা নিশ্চিন্ত সেই দিনগুলোতে, মেতে উঠতে চায় উৎসবের রঙে, ফিরতে চায় সবার মাঝে, কাজ ফেলে পালাতে চায় অকারণ খুশির খোঁজে।