আমি আমার এই বেআক্কেলে মনকে নিয়ে যে কি করি? যখন তখন যা খুশি ধাঁ করে বলে বসে।
আজ বলে কি না, “আজকাল নীল ঠাকরুনের সবুজ দ্বীপে আইন কানুন শিব ঠাকুরের একুশে আইনকেও হার মানাচ্ছে দেখি। চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক, ওদিক, ডাইনে, বাঁয়ে, রানির কাছে খবর ছোটে, পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে”, মন এই বলে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারিপাশটা দেখে নিল চট করে। “বলা যায়না কে কোথায় ওঁত পেতে আছে! কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে, পেয়াদা এসে পাকড়ে ধরে।”
“উফ, তুমি নিজের কাজে মন দাও না, মন আমার।” মৃদু ভর্ৎসনা করলাম বাচাল, বেআক্কেলে মনকে, “তা না সকাল সকাল সুকুমার রায়ের একুশে আইন নিয়ে পড়লে?”
“আহা!‘সেথায় রাত্রি ন’টার পরে নাচতে গেলে টিকিট লাগে – নাচলে পরে বিন টিকিটে, দমদমাদম লাগায়ে পিঠে’! কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে, একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।” আমাকে তোয়াক্কা না করে আমার দিকে একবার চোখ মটকে মন নিজের মনে ছড়া কাটতে লাগল, “নীল ঠাকরুনের সবুজ দেশে আইন কানুন সর্বনেশে …”
“সকাল থেকে কি সব নীল সবুজের মেলা বসেছে?” বেশ বিরক্ত লাগল আমার এসব হেঁয়ালি দেখে।
মন নিরুত্তাপ, মাথা নেড়ে বলল, “শোন আর বোঝো, না বুঝলে ফক্কা –
“যে সব লোকে সত্যি বলে, তাদের ধরে খাঁচায় রেখে, কানের কাছে নানান সুরে, নামতা শোনায় একশো উড়ে – সামনে রেখে রানির বাণী – হিসেব কষায় একুশ খানি।
কোথাও যদি আগুন ধরে, শুধু ‘ষড়যন্ত্র’ নজরে পরে,
কারো যদি কপাল পোড়ে, আগেই চক্রান্তের তলব পরে,
খুঁচিয়ে পিঠে, গুঁজিয়ে ঘাড়, দিনকে বলায় রাতের আঁধার” – এবার বুঝলে কিছু?”
“উফ, সব বুঝেছি। সব ঠিক হবে! এত তাড়া কিসের? সবে তো দশ মাস হল। এত দিনের অনড়, অচলায়তনকে চালাতে তো সময় লাগে, না কি? দেয়ার হ্যাজ টু বি সাম মেথড ইন দ্য ম্যাডনেস। আমরা এত দূরে বসে সব কি দেখতে পাচ্ছি যে সব বুঝব?” মনের মাথায় হাত বোলাতে গেলাম ঠাণ্ডা কর’ব বলে।
“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ? দিবাস্বপ্ন ভাল, কিন্তু তা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে তাকে ইংরেজিতে ‘হ্যালুসিনেশান’ বলে, জানো তো সেটা?” ভড়কে উঠল মন।
আমি আর এত ভণিতা সহ্য করতে পারলাম না। “এবার দিনের আকাশে তারা গোণা বন্ধ ক’র দেখি। রাখো তোমার ছড়া কাটা!”
আমার কথা যেন কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, এমন ভাব করে, মন ভাবুক সুরে বলে উঠল “আর ওই নীল আকাশের আকাশী রঙ যদি মাটিতে নামে? কি নাম দেবে তাকে? নিলঠাকরুনের নীলের প্রলেপ?”
আবার সেই বাঁকা মনের আঁকাবাঁকা কথা।
“রাণী ‘পরিবর্তন আনব’ ব’লে, সবার মন দিল ভ’রে,
আকাশ ছোঁয়া আশার প্রাসাদ, সেথায় একুশ প্রমিস ঘর করে;
পরিবর্তন এলোও শেষে, এক নীল শৃগালের বেশে।
বাড়ির দেওয়াল, স্কুলের গেটে,
সেতু, রেলিং, মায় ময়দানের অশ্বত্থ, বটে;
ঠাকরুণের এই নীল প্রলেপে, আকাশ মাটি গেল মিশে।”
কি আর বলে বোঝাই তোমায় মন? মনে মনে আমিও জানি তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্যি। দশ মাস আগে দেখেছিলাম লাল আকাশটার রক্তিম আভা আস্তে আস্তে কেটে গিয়ে ফুটে উঠছে নীল রূপ। ছত্রিশ বছর যে ভারি জগদ্দল পাথরটা বুকের উপর চেপে বসেছিল, তার তলা থেকে রেহাই পেয়ে জরাগ্রস্ত শহরটা খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নিতে শুরু করেছিল সবে। সবার মনে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল সেদিন। আমিও আমার পরবাসী সংসারে যেন এক নতুন আশা নিয়ে ফিরেছিলাম। হয়তো মনের কোণে ফেরার টান জন্মেছিল সেদিন।
আজ তার বদলে দূরে বসে আমার প্রিয় শহরটাকে নীলবর্ণ শৃগালে রূপান্তরিত হতে দেখছি। নানা চাল বানচাল হয়ে যাচ্ছে, অনেক কিছু বেহিসাবি হয়ে পড়ছে আরও। মাঝেমাঝে আমিও প্রশ্ন করি, ‘ব্যাস, এই সেই ‘পরিবর্তন’?’ তারপর আবার নিজেকে সংযত রেখে, নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে, দূরে বসে অপেক্ষা করি দিন বদলের। দশ মাসের গর্ভাবস্থার শেষে সবে প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে বুঝি, দেখিই না দানব জন্মায় না দেবশিশু। তাই বলি কি মন, তুমিও দাঁড়ে বসে তোতাপাখির মত ছড়া না কেটে আর একটু ধৈর্য ধরো।
……………………………………………………………