RSS

পলাশ

পলাশ ফুল ফুটতে দেখেছ? সারা শীতভর পাতা খসানো কঙ্কালসার গাছটা ধূসর আকাশের পানে শুকনো ডালগুলো মেলে যখন দাঁড়িয়ে থাকে, কোন’দিন ভেবেছ উষ্ণতার একটু পরশ পেলেই কি করে তার হৃদয় চিড়ে পলাশের পাপড়িগুলো রক্তবিন্দুর মত ফুটে ওঠে?

সেই কত বছর আগেকার কথা, কলেজে যাওয়ার রাস্তায় যখন বাসটা ময়দানের গা ঘেঁষে পার্ক স্টিটের দিকে একটু হেলে পড়ে মোড় ঘুরত, আমি জানালার পাশে সিটটায় বসে হাঁ করে ময়দানের পলাশ গাছটাকে দেখতাম। ইঁট, কাঠ, পাথরের ধূসর এই শহরটায় বসন্তই বা কি আর কীই বা শরত? হেমন্তের আশা তো করাই দুরাশা। তবুও ধুলো ওড়া, ন্যাড়া মাঠটার ধারে রিক্ত, রক্তাক্ত গাছটাকে দেখে মনে কেমন যেন দোলা লাগত। হয়তো বয়সটাই তখন অমন ছিল, অথবা মোটা, মোটা রোমান্টিক নভেল পড়ে, শীল্পির কল্পনায় আঁকা পলাশের রঙে মেতে, বসন্ত রাঙ্গানো পলাশের ওপর কবিদের লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস শুনে বুঝি আমিও পলাশ নিয়ে একটু বেশীই ভাবিত হয়ে উঠেছিলাম। যাই হোক, কলেজ জীবনের ঐ তিনটে বছর আমার মনের একতা কোণা রাঙ্গিয়ে, মাতিয়ে রেখেছিল ময়দানের সেই পলাশ।

তারপরের বছরগুলো কোথা দিয়ে যে কেটে গেলো তার হিসাব মেলাতে বসলে সব কিছু আরও বেহিসাবি মনে হয়। তাই তার হিসেব মেলাতে আর চেষ্টা করি না।

বেহিসাবি এই মনকে নিয়ে সেদিন বেড়িয়ে ছিলাম দাহানুর পথে বোর্দি বীচ যাব বলে। বোম্বের শীত তখন পালাই পালাই করছে, হাওয়ায় নরম রোদের ঊষ্ণ পরশ। শহরটাকে পিছনে ফেলে লম্বা সর্পিল হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটছে, মাজে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে ঠিকানা খুঁজছে, ভুলভাল অলি গলিতে ঢুকেও পড়ছে। এই রকমই একটা ভুল গলির মুখে থমকে থেমে দিক ঠিক করার চেষ্টায় ব্যাস্ত সবাই। এমন সময় চোখে পড়ল গলির বাঁকে চেনা মুখ, চেনা হাসি, চেনা সেই রঙ – নিবিড় নীল আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পলাশ গাছ – ডালগুলো থেকে ফেটে পড়ছে আগুনরঙ্গা ফুল, মাটিতে লুটিয়ে আছে শুকনো পলাশের গালিচা।

বলব কি? অনেকদিন পর প্রিয়জনের সাথে দেখা, ইচ্ছে হল বুকে জড়িয়ে ধরি।

‘সেটা একটু বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না?’ বলে বসল মন। অতএব, বাধ্য হয়ে ইচ্ছের ডানাটি ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে তুলে রাখলাম আবার মনের কোণায়। ‘দেখা তো পেলাম আবার,’ মনে মনে হাসলাম।

আরো মজা কি জানো? সেদিন সারা পথ রাস্তার দুই ধারে অনেকগুলো পলাশ গাছ চোখে পড়ল, কয়েকটাকে ক্যামেরা-বন্দি করে বাড়িও নিয়ে এলাম। আর বিকেলে, বাড়ি ফেরার পথে ঢলে পড়া রোদের নরম আলোয় দেখলাম এই শহরটার আনাচে কানাচে, রাস্তার কোণায়, বাড়িগুলোর আড়ালে, বড় বড় হোর্ডিংগুলোর পিছনে বেশ ক’টা পলাশগাছ লুকিয়ে আছে। এতদিন নজরেই পড়েনি বা হয়তো ব্যাস্ততার মাঝে চোখ তুলে খুঁজিওনি আমি।

আরোও আশ্চর্য হলাম গতকাল। তিনটে নাগাদ গনগনে রোদে মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে বেড়িয়েছি। কাল মতলব ছিল মেয়ের সাথে গল্প করতে করতে একটু লম্বা রাস্তা ধরে হেঁটে ফিরব। তাই স্কুলের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার উল্টোদিকে, মাঠের গায়ের ফুটপাথটা দেখে আমি থ। মাঠের ঘাসে, ফুটপাথ জুড়ে সদ্য ঝরা পলাশের মেলা।

p2

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন মার্চ 25, 2013 in বিভাগবিহীন

 

পয়লা বোশেখ

কালকের পয়লা বৈশাখ অতীতের কিছু পয়লা বৈশাখের স্মৃতি হঠাৎ তাজা করে রেখে গেছে। আজ দোসরা বৈশাখ, ১৪১৯, রবিবার। সকাল থেকে মন সেই স্মৃতি চারণে মশগুল। ব্লগের পাতায় তুলে দিলাম তারই কিছু মুহূর্ত।

চৈত্র মাসের শেষ দিনটা আমি ছোটবেলায় কোনদিন বাড়িতে কাটিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেই ছুটির ঘণ্টা বাজার তর সইত না। বেল বাজলেই সব্বার আগে ক্লাস ছেড়ে দৌড়।

মামারবাড়ির পাড়ায় স্কুল হওয়ার এটাই মজা। কোনো না কোন ছুতোতে বা বিনা কারণেই রোজ একবার করে ঢুঁ মারা যায়। তবে চৈত্রের শেষ দিনে, মুচিপাড়া থানার গোলাপ শাস্ত্রী লেনের লম্বা রকওয়ালা দোতলা বাড়িটার প্রতি টানটা একটু বেশিই হত। সদর পেরিয়ে, একতলার বৈঠকখানার স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারটা চট করে পিছনে ফেলে উঠে এক দৌড়ে উঠে যেতাম দোতলায়। সেদিন আর ভাত খেয়ে ঘুম পেত না, বিকেলে ছাদটাও ডাকত না, জানালার নিচে আইসক্রিমওয়ালা হেঁকে গেলেও কানে যেত না, লেবুতলা পার্কের আলুকাবলিওয়ালাটাকেও সেদিন মনে পড়ত না।

মামারবাড়ির দোতলার খাবার ঘরে তখন ঘটনার ঘনঘটা। এক কোণে সুতোর রিল, শোলার কদমফুল, আমপাতা আর এক ঝুড়ি গাঁদাফুলের মালা। টেবিলের ওপর দিদার হাতে রাঁধা নারকেল দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, কচি পটল ভাজা, ভেটকি মাছের কাঁটা দিয়ে ছ্যাঁচড়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি ইত্যাদি। মান্ধাতার আমলের ফ্রিজটার পাশে বড় বড় চাঙ্গাড়ি – হলুদ সেলোফেনে ঢেকে, গোলাপি সুতো দিয়ে বাঁধা। পাশে একতাড়া কাগজের খোলা বাক্স।

পেটপুজো শেষে শুরু হত দক্ষযজ্ঞ।

আচ্ছা, মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি ভরা যে বাক্সগুলো আসে, তার রহস্য জান কি? ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে, খাজে খাঁজ মিলিয়ে, খাপে খাপে বসিয়ে মিষ্টির বাক্স বানিয়েছ কোনদিন? ঠিক অরিগামির হাঁস, বক বা ফুল বানানর মত, তাই না? আমাদের কাজ শুরু হত ওই বাক্স বানান দিয়ে। নজর যদিও বাক্সের উপর থেকে সরে, বারে বারে চলে যেত ঘরের কোণে রাখা চ্যাঙ্গারীগুলোর দিকে – যার হলুদ সেলফেনের নিচে গা ঢাকা দিয়ে আছে ভীম নাগ ময়রার দরবেশ – জাফরানি আর লালচে নরম বোঁদের নাড়ু, উপরে শুকনো ক্ষীরের পরত – মন কি আর শূন্য বাক্সে বেশিক্ষণ বসে? বাক্স তৈরির শেষে, দিদা হাতে ধরাত আমপাতা আর শোলার কদমফুলের তোরণের কাজ। তা শেষ করতে পারলেই দরবেশ চাখার সুযোগ। আর বিকেলে চায়ের সাথে রামপদ রায়ের সিঙ্গারা। রাতে দিদার হাতে পরটা না হলে পেটই ভরত না। আর তারপর রাতভর ভোরের অপেক্ষা। টাটকা গাঁদাফুলের মালাগুলোও অজগরের মত প’ড়ে থাকত ঝুড়িতে, কাল সকালের অপেক্ষায়।

পরদিন কাকভোর থেকেই সরগরম একতলার বৈঠকখানা। হাওড়া হাট থেকে আসত আরও বাহারি ফুল, মিষ্টির দোকান থেকে ক্যানেস্তারা ভরে আসত টাটকা, গরম, খাস্তা নিমকি, চাঙ্গাড়ি ভরা ভীম নাগের “শুভ নববর্ষ” সন্দেশ, গরমাগরম সিঙ্গারার ঝুড়ি – ঘেমো মুটেগুলো যে যার ক্যানেস্তারা, চ্যাঙ্গারী নামিয়ে নানা সুরে”নয়া সাল”এর বকশিসের আবদারে জুটে যেত।

এতো তোড়জোড় কিসের? কেন, পয়লা বোশেখে দাদুর দোকানের হাল খাতার পুজোর জন্য। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির পাড়ায় সেদিন বিশাল দোকানটায় টেবিল চেয়ার সরিয়ে, ঝাড়পোঁছ করে, ধুয়েমুছে, এক কলি চুনকাম চড়িয়ে, নতুন শতরঞ্চি পেতে সাজানো। সামশেরদাদা দেওয়ালে মালা সাজাতে, কাশেমদাদা দরজার মাথায় কদমফুল আর আমপাতার তোরণ লাগাতে আর এক কোণে মামারবাড়ির পুরোহিত আসন পেতে পুজোর আয়োজনে ব্যাস্ত। লাল হালখাতার প্রথম পাতায় সিঁদুর মাখা রুপার টাকার ছাপ পড়ত, চুনকাম করা দেওয়ালে নতুন করে আঁকা হত তেল সিঁদুরের সিদ্ধিদাতার স্বস্তিকা। ধুপ ধুনোয় ভরে যেত ঘর। আর তারপর সারা সকাল বৌবাজার পাড়ার লোকজনেদের মিষ্টির বাক্স বিলানো।

আমার স্মৃতিজড়িয়ে আছে সেই কদমের তোরণে, মন প’ড়ে আছে তাজা চুনকাম করা দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে, নতুন পাওয়া জামাগুলোর সরল আনন্দে, রাতে দিদার হাতে লুচি মাংসে আর প্রতি পয়লা বৈশাখের হালখাতার প্রথম পাতায়।

picture courtesy : inmagine.com

 
১ টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন এপ্রিল 15, 2012 in বিভাগবিহীন

 

একুশে আইন – revisited

শিব ঠাকুরের আপন দেশে,

আইন কানুন সর্বনেশে!

কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,

পেয়াদা এসে পাকড়ে ধরে —

কাজির কাছে হয়ে বিচার,

 একুশ টাকা দণ্ড তার ।।


সেথায় সন্ধে ছ’টার আগে

হাঁচতে গেলে টিকিট লাগে —

হাঁচলে পরে বিন টিকিটে —

দম দমা দম লাগায় পিঠে,

কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে —

একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে ।।

কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,

চারটি টাকা মাশুল ধরে,

কারুর যদি গোঁফ গজায়,

একশো আনা ট্যাকশো চায় —

খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়, 

সেলাম ঠোকায় একুশ বার ।।


চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,

এদিক, ওদিক, ডাইনে, বাঁয়ে,

রাজার কাছে খবর ছোটে,

পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,

দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়,

একুশ হাতা জল গেলায় ।।


যে সব লোকে পদ্য লেখে,

তাদের ধ’রে খাঁচায় রেখে, 

কানের কাছে নানান সুরে,

নামতা শোনায় একশো উড়ে —

সামনে রেখে মুদির খাতা–

হিসেব কষায় একুশ পাতা


হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে,

নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,

অমনি তেড়ে মাথায় ঘষে,

গোবর গুলে বেলের কষে,

একশোটি পাক ঘুরিয়ে তাকে

একশো ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।।

 

একা এবং সোশাল-নেটওয়ার্ক

একটা লেখার ঝোঁকে অনেকক্ষণ জেগে আছি আজ, কখন যে মাঝরাত গড়িয়ে গেছে হুঁশও হয়নি। বাকি সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, সারা বাড়ি নিঝুম। জানালার বাইরে মধ্যরাতের শহরটা রাতের আকাশের মত  অন্ধকার, আশপাশের বাড়িগুলো অন্ধকারের ঘোমটা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে, জেগে আছে শুধু রাস্তার দুধারের নিওন বাতিগুলো। নীচে রাস্তায় কমে গেছে গাড়ির ভিড়, সেই সুযোগে নেড়ির দল সরু গলি ছেড়ে বড় রাস্তা দখল করতে নেমেছে, তাদের চিৎকার মাঝে মাঝে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে রাতের নীরবতাকে। আর শুধু একটা দুটো দলছুট অটোরিকশা রাতের সওয়ারির খোঁজে এখনও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।

ঘরের আধো অন্ধকারে আমার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে টেলিভিশনটা মিউট করে চালানো। এদিকে  মগজের অবস্থা “খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না” – লেখাটা এক জায়গায় এসে থেমে গেছে – মনও আর বশে নেই, সেও উড়ি উড়ি, এই সময়ে আর লেখায় বসবে না।

আমি কম্পিউটারের ওয়ার্ড ডকুমেন্টটা বন্ধ করে ইন্টারনেটের ব্রাউসারটা খুললাম। অভ্যাসবশত ফেসবুক আর টুইটারে লগ ইন করে চোখ গেল স্ক্রিনের কোনায় ঘড়ির দিকে – রাত দুটো! কিন্তু ল্যাপটপের এল সি ডি স্ক্রিনের ওপারে দেখি এখনও বয়ে চলেছে এক সমুদ্র নিস্তব্ধ কথার স্রোত। পূর্ব গোলার্ধের বেশিরভাগ মানুষই যখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, কিছু নিশাচর তখনও জেগে। তবে শুধু জেগে থেকে ক্ষান্ত নয় তারা, পুরদস্তুর আড্ডার আসর চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে, কেউ আড়ি পাতছে অন্যের কথায়, কেউ বা ঝগড়ায় ব্যস্ত, কেউ ব্যস্ত নিজের কবিতা পড়তে, একজন ব্যস্ত নিজের সাম্প্রতিক ফরেন ট্রিপের অ্যালবাম ফেসবুকে লাগাতে, তো অন্যজন ব্যস্ত অচেনা ফেসবুক বন্ধুর জীবনের ঘনঘটা ভরা অ্যালবাম থেকে তাকে একটু চিনতে। টুইটারে বয়ে চলেছে তর্ক-বিতর্কের ঝড়, রাতজাগা এক সুন্দরীর ব্যর্থ প্রেমের প্রলাপ, বিশিষ্ঠ এক ফিল্মস্টারের ফিলসফি ক্লাস, সিনেমার সমালোচনা, রাজনিতি, কূটনীতি, রান্নাবান্না, লেখকের স্মৃতিচারণ, স্কচ, রাম, জিনের ফোয়ারাও। আজ মাঝরাতে জেগে থেকে এক নতুন জগতের হদিস পেলাম।

মন শুধালো, ‘আচ্ছা, এদের পাশের মানুষগুলো কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে, নাকি এরা সবাই একা, অবিবাহিত, পিজিতে  বা হস্টেলে থাকা কম বয়সী ছেলে মেয়ে? ঘর ছেড়ে দূর শহরে চাকরি করে বুঝি? এদের ঘর বাড়ি নেই, সংসার নাই, কাল সকালে উঠে অফিস যেতে হবে না, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হবে না? এত রাতে এরা জেগে আছে কেন? এদের ঘুম পায় না বুঝি, ইনসমনিয়াক?’ বাতুল মনকে দেবার মনের মত কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।

আধুনিক নগর-সভ্যতার অভিশাপ আর জরা-ব্যাধি-মড়ক নয়, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, অদৃশ্য এক শত্রু, একাকীত্ব। নিঃসীম সমুদ্রে ভেসে বেড়ান দ্বীপ আমরা। দিনভর কেরিয়ারের দাসত্ব, ই এম আই, স্কুল ফি, গাড়ির লোন, সংসারের নানা মাথাব্যাথা। ফুরসৎ কথাটা বাংলা-ঈংলিশ মোটা ডিকশনারির পাতার মাঝে হারিয়ে গেছে। বন্ধু আছে, কিন্তু সময় নেই। আবার কখনো সময় থাকলেও মনের মত বন্ধু থাকে না। বন্ধু থাকে তো মনের মানুষ পাওয়া যায় না। যেন আমরা প্রতি পল আরও একটু বেশি নিঃসঙ্গ, আরও একা হয়ে পড়ছি।  মানুষের একাকীত্বের কি কারণ? নানা মুনির নানা মত। এই একটা অসুখ আমাদের প্রতি নিয়ত গ্রাস করে চলেছে, কিন্তু তার কোন ওষুধ খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও।

আজ মাঝরাতে ব্রাউসারের পাতায় পাতায়, ফেসবুকের আপডেটে, টুইটারের টাইমলাইনে, অর্কুট, মাই স্পেস, গুগুল প্লাস, পিন্টারেস্ট- এর মত “সোশাল নেটওয়ার্ক”এর দেয়ালে দেয়ালে দেখলাম নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন এক জনস্রোত – নানা জন, প্রচুর কথা, হাজার প্রশ্ন, মান-অভিমান, ভাব, ভালবাসা, হিংসা, ঝগড়া – ঠাণ্ডা স্রোতের মত নীরবে বয়ে চলেছে ঠাণ্ডা কাঁচটার ওপারে – একাকীত্বের নিঃশব্দ কোলাহল। সে জগতে কেউ ঘুমোয় না, কেউ স্বপ্নও দেখে না। এত কথার, এত আওয়াজের মাঝে শুধু একটা কথাই শুধু সবাই নিঃশব্দে চিৎকার করে বলে চলেছে, “আমি একা, আমি একা, আমি একা”।

তাহলে নাগরিক একাকীত্বের একমাত্র ওষুধ কি এই ছায়ার মায়া জগৎ, এই ‘সোশাল নেটওয়ার্ক’ ? ছায়া মানবের সাথে ছায়া মানবীর কথোপকথন, বন্ধুত্ব, প্রেম, অনুরাগ, বিরাগ? যেন এক অদৃশ্য তরঙ্গ বয়ে চলেছে মহাদেশ থেকে মহাদেশে, ছুঁয়ে চলেছে জীবন থেকে জীবনে, বন্ধুত্ব গড়ছে, দ্বীপের মত ভেসে বেড়ান মানুষগুলোর মাঝে গড়ে উঠছে সেতু। এদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা মনে করে যে এই ছায়া সরণির পথে পাওয়া বন্ধু রক্ত মাংসের মানুষের চেয়ে অনেক ভালো, দুঃখ দেবে না, ঠকাবে না, বন্ধুত্বের পরিবর্তে হয়তো প্রতিদানও চাইবে না। এমনই ভালো। ‘লগ ইন’ করে হাত বাড়ালেই বন্ধু আর ‘লগ আউট’ করে কম্প্যুটার অফ করলেই সব দায়বদ্ধতা শেষ।

কিন্তু এই জগত কি ওষুধ, নাকি অসুখ? যে একাকীত্ব কাটানোর জন্য এই একা মানুষগুলো দিনরাত এক করে ঐ মায়াজালে জড়িয়ে আছে, সেই একাকীত্ব কি কাটছে? নাকি বেড়ে চলেছে মানুষে মানুষে ব্যাবধান? ছায়া বন্ধুর টানে কি ভুলে যাচ্ছে না সে আসল বন্ধুকে? সে কি আরও একা হয়ে পড়ছে না?

 
5 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন এপ্রিল 10, 2012 in বিভাগবিহীন

 

ছাগলে কি না খায় …

মাঝে মাঝে ভাবি। আর অবাক হই, দেশটা কি ছাগলে ভরে গেল? না, না। একটু মন দিয়ে পড়ুন, আপনিও আমার কথার মানেটা ধরতে পারবেন।

আমার মনও সেদিন না বুঝে আঁতকে উঠেছিল, ‘সে কি? বেশ তো দু’পাওয়ালা মানুষগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে, টিভি, সিনেমা, ফেসবুক, টুইটার নিয়ে মেতে আছে, মাঝেমাঝে একটা আধটা বইও পড়ছে – এর মাঝে তুমি ছাগল দেখলে কোথায়ে? অনেক হয়েছে, এবার তোমার ওই খেয়ালে, খেয়ালে বিচরণ করাটা ছাড়ো, লেখায় মন দাও।’

এহেন মনকে বোঝাতে বসলাম। দেশ ভরেছে দু’পেয়ে ছাগলে। নাহলে টিভিতে দিন রাত শাশুড়ি-বউএর প্যানপ্যানানি, রদ্দি মার্কা লেখা গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজের কলম, শস্তা, চটুল গানের কলি, বস্তাপচা ফর্মুলায় ঢালা সিনেমা – এসবে বাজার ছেয়ে গেছে? আর এই দু’পেয়ে মানুষরূপী ছাগলের দল তাই তারিয়ে তারিয়ে চিবোচ্ছে?

মন বলল, ‘ইস, আস্তে! পাবলিককে ছাগল বললে? পাবলিক তো তোমার ব্লগও পড়ে। তারা রেগে যাবে!’

আমার মত হল, গানের কলি যদি হয় ‘ভাগ, ভাগ ডি কে বোস’; ‘বাপি, বাড়ি যা’ – পারিবারিক সংবাদ পত্রের, ম্যাগাজিনের ছত্রে ছত্রে যদি শুধু থাকে স্বল্পবাসিনি সুন্দরীদের ছবি – আর যদি ‘পাবলিক’ যদি তাই বিনা প্রতিবাদে, হাপুস-হুপুস শব্দে খায়ে, তাহলে আমার পাবলিককে ‘ছাগল’ বলাটা কি অন্যায়?

এই সেদিনকার কথা। একটা নতুন বই পড়তে শুরু করেছি। লেখক গত দুই দশক ধরে ভালো ভালো কিছু বই লিখে নামডাক করেছেন। ওনার লেখা পড়তে আমার বেশ ভালই লাগে। লেখনীতে একটা স্বচ্ছতা আছে আর ওই ইংরাজিতে যাকে বলে ‘ক্লিন ফীল’ – তাও আছে। নতুন বইএর প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করে সবে দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে ঢুকেছি, প্রেমিক-প্রেমিকা সবে চোখে চোখে প্রেমে পড়ছে – তৃতীয় প্যারাগ্রাফেই সেই চোখে চোখে প্রেম হঠাৎ একলাফে দেখি বিছানায় পৌঁছে গেল – বিনা বাক্য ব্যয়! বিনা কোনও কারণে! বইটা শেষ অবধি পড়েছিলাম, প্রিয় লেখকদের একজন বলে।

পরে জানলাম এক গুঢ় সত্য। ‘ব্যবসা করে তো খেতে হবে, আমাকেও, লেখককেও, পাবলিশারকেও, ফিল্মস্টারকেও, ফিল্ম ডাইরেক্টরকেও, নায়কেও, নায়িকাকেও – এমনকি খবরের কাগজগুলোকেও! তাই পাবলিক যা খেতে ভালবাসে আমরা তাই খাওয়াই। টি আর পি, বেস্ট সেলার লিস্ট, সুপারহিট কথাগুলো তো আর এমনি উঠে আসেনি, পাবলিক যা কিনছে, দেখছে, ভালবাসছে – সেটাই ট্রেন্ড আর তাতেই প্রফিট। পাবলিককে অবজ্ঞা করে কে কবে লাভ করেছে?’ – কার থেকে? তা নাই বা বললাম।

মন মাথা নেড়ে, চুক্‌ চুক্‌ করে বলল, ‘আর এই পাবলিকই একদিন সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল, বিমল, বুদ্ধদেব, হৃষীকেশে মজেছিল? আজ কি হল? খিদে বদলে গেল? কেন?’

আসলে মুশকিল কি জানেন? ব্যবসা। আর ব্যবসা দেবে কে? ওই গড্ডালিকা প্রবাহ। তাই ওই গড্ডালিকা প্রবাহ যাতে খিদে, পাবলিক যা ‘খাবে’, ব্যবসায়িরাও তাই বেচবে। তাই যেই ব্যবসায়ীদের বোধোদয় হয়েছে যে পাবলিকের ‘সেক্সের’ খিদেটাই সব থেকে অদম্য, ব্যাস্‌! গান, গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজ, ব্লগ – মায় ডিওডোরেন্ট, মোবাইল, ঘড়ি, সানগ্লাস পর্যন্ত – সব কিছু বেচতেই একই মশলা, সেক্স আর মন উস্‌কে দেওয়া সুড়সুড়ি।

নতুন যারা ব্যবসায় নেমেছে – ধরুন নতুন বই লিখেছে – সে জানে ‘বই বেচতে কয়েকটা সাহসী চ্যাপ্টার না লিখলে যে বই বিক্রি হয় না’ – পাবলিশার বলেছে। যে নতুন নায়ক বা নায়িকা, সেও তো লজ্জার তোয়ালে খসিয়ে না নাচলে তার ছবি দেখতে কেউ যাবে না – ডাইরেক্টার, প্রোডিউসার বলেছে। আর এদের দোষ দিয়ে লাভ কি? পাবলিক খাচ্ছে যে!

একটা সময় হয়তো ছিল যখন লেখক-লেখিকারা, সিনেমাওয়ালারা পাবলিকের মান উন্নত রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু, অনেক দিন হয়ে গেল এই ‘আঁতেল পোষণে’ আর কেউ পয়সা ঢালেনা। দলে, দলে ছাগল যখন স্বেচ্ছায় পয়সা ফেলে, সিটি মেরে যত্তসব রাবিশ গিলছে, তখন কতিপয় আঁতেলের গা জ্বলানো ন্যাকামি আর সূক্ষ্ম, চুলচেরা বিচার দিয়ে কি হবে?

বরং, প্রবীনবর, আপনি দূরে দাঁড়িয়ে ‘হায়, হা হতোস্মি’ না করে, আসুন এই নবীন সেক্সসেলারদের ভিড়ে ভিরে পরুন। তারপর? তারপর সামনে অপার সম্ভাবনা – কালজয়ী নাটক, নভেল, লিটফেস্ট, ফিল্মফেস্ট, বলিউড, হলিউড! তবে সব কিছুর আগে ছাগল ভোজন। ওইখানেতেই শুরু, কেননা, ছাগলে কি না খায়?

Picture courtesy ; bestclipartblog.com

 
১ টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন ফেব্রুয়ারি 23, 2012 in বিভাগবিহীন

 

পরবাসে শরত যাপন

প্রায় তিন মাস বাদে আজ সারাদিন রোদ্দুর। শেষ দুপুরের মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসে বসে নতুন আসা পুজাবার্ষিকীটার পাতা উল্টোচ্ছিলাম। একটা পাতায় এক মাঠ ভরা সাদা কাশ ফুলের ঢেউ, আর এক পাতায় মা দুর্গার ত্রিনয়নী রূপ।

পরবাসে শরত কাল আমার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে, আকাশে সাদা মেঘগুলোর বাড়ি ফেরার পালা। জানলার পর্দায় মাঝে মাঝে খেয়ালি হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছে আর একটা গঙ্গাফড়িং পর্দার ছায়ার সাথে লুকোচুরি খেলছে। দূরে, ঝিলের বুকে তিরতিরে হাওয়া ঢেউ তুলছে মাঝেমাঝে – আকাশটা বর্ষা শেষে বৃষ্টি ধোওয়া, ঝকঝকে নীল।

তেরো বছর হল আমার প্রবাসে, প্রবাসে শরত কাটানোর। এ ক’বছর যে অল্প কয়েকটা দেশে আর শহরে থাকার সুযোগ পেয়েছি, অবাক হয়েছি এই দেখে যে শরতের এই দিনগুলো সবখানেই এক রকম – গাঢ়, সোনালি রোদ, নিবিড় নীল আকাশে সাদা, সাদা পাল তোলা মেঘ – আর এক আনমনা, প্রবাসী বঙ্গবাসিনী। কাজ ফেলে মাঝে মাঝেই চোখ চলে যায় আকাশপানে, মন টানে দেশপানে, উপড়ে ফেলা শিকড়টা মাটির টানে কাতরায়। আমার মনও দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে, ডায়রির পাতায়, ব্লগের দেওয়ালে শরতচারণ করে। প্রতিবার ভাবি, ‘অনেক তো হল, পরবাসেই যখন ঘর, মন, তুমি এখানেই মন দাও। আর কেঁদো না মাটির টানে’।

কিন্তু আমার প্রবাসী অভিমানী মন জড়িয়ে থাকে শরতের সঙ্গে জড়ানো স্মৃতির জালে। আমাদের মধ্য কলকাতার পুরানো বাড়ির ছাদের কোণায়, বড় একটা টিনের ড্রামে ছিল একটা শিউলি গাছ। শরতের ভোরে ছাদের ওই কোণাটায় পড়ে থাকত দুধেল সাদা আর কমলা রঙের একটা গালিচা – মুঠোভরে কুড়িয়ে বেড়াতাম শিউলি। শিউলির সেই পরশ এখনও লেগে আছে মুখে, চোখে, চুলে, মনে – মন খুঁজে মরে সেই শিউলি।

আরও স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে, জোর করে মনকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করি সামনে রাখা কম্পিউটার স্ক্রিনে, সামনে মেলে রাখা বইটার পাতায়। কিন্তু দুচোখ ভরা তখন অতীতের ছবি, গন্ধ। আমার ঠাকুমার দেরাজের তাকে রাখা পাটে পাটে ভাঁজ করা, কড়া মাড়ের নতুন তাঁতের শাড়ির থাক; মায়ের নতুন ঢাকাই-এর গন্ধ; পিওর সিল্কের নরম পরশ; রোজ সকালে দুই বোনের ক্যালেন্ডারে দিন গোনা; রোজ সকালে বাবার কাছে পুজাবার্ষিকীর জন্য আব্দার; মা-কাকিমার সঙ্গে পিসি-মাসিদের বাড়ি আলতা-সিঁদুর দিতে যাওয়া। রান্নাঘরে বয়াম ভরা কুঁচো নিমকি, গজা, নারকেল নাড়ু – উফ, মনের সুতোয় টান দিলাম, ফিরিয়ে আনার ব্যর্থ চেষ্টায়। এবার একটু কড়া গলাতেই বললাম, ‘শিকলি কেটে তো অচিন আকাশে ডানা মেলেছ অনেক দিন, আবার কেন চেনা দাঁড়ের জন্য ঘ্যানঘ্যান?’

মনে তখন ঢাকের বাদ্যি। পাটভাঙা নতুন জামার খুশি, শ্যাম্পু করা উড়ো চুলে এলো বেণি, বুকের ভিতর একটা তিরতিরে কম্পন সবসময়, আনন্দের। অষ্টমীর সকালে অপটু শাড়ির আঁচল টেনে, দুরুদুরু বুকে, আড়চোখে চোখ রাখা হঠাৎ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা আরেক জোড়া চোখে, আর ঈষৎ হেঁসে, চোখ নামিয়ে পালিয়ে যাওয়া। মায়ের সদ্যস্নাত এলো চুলের সিঁথিতে টানা সিঁদুরের রেখা, লাল পাড় গরদের শাড়ি, সোনার চুড়ির ঠুং-ঠাং। আর সন্ধিক্ষণে, সন্ধিপূজার প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় ত্রিনয়নীর ম্রিয়মাণ হয়ে আসা মুখ, ছলছলে চোখ; সিঁদুরে রাঙা বিদায় বেলার উদাস হাসি, ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা।

প্রতি বছর এই সময় শরত আমার দ্বারে এসে আমায় হাঁসায়, কাঁদায়, ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্মৃতির স্রোতে অতীতের ফেলে আসা শরতের দিনগুলোতে। আমার অবুঝ মনের অভিমান কোথায় আমি বুঝি। ফিরে যেতে চায় সে ফেলে আসা নিশ্চিন্ত সেই দিনগুলোতে, মেতে উঠতে চায় উৎসবের রঙে, ফিরতে চায় সবার মাঝে, কাজ ফেলে পালাতে চায় অকারণ খুশির খোঁজে।

 

অ-সুখ অসুখ

Read the original post on পথে প্রবাসে

“রাজার হয়েছে এক অদৃশ্য, দুরারোগ্য ব্যাধি – রাজার খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই, রাজকার্যে মন নেই – তিনি খালি আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ‘ফোঁস’ করেন আর বলেন ‘হায়’ – ঠোঁটে হাসিও নেই, মুখে কথাও নেই – শুধু শূন্য দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজে ফেরেন – রাজবদ্যি নাড়ি দেখে, মাথা নেড়ে বিধান দিলেন – ‘কঠিন ব্যারাম, এ হল ‘অ-সুখ’’’।

পথে, প্রবাসে, যখনই পুরনো আত্মীয়, নতুন বন্ধু, প্রতিবেশী যাদের সঙ্গেই দেখা হোক বা কথা হোক, এক গাল হেসে প্রশ্ন করি “কেমন আছো?”, বেশির ভাগ সময়েই বিরস বদনে, শুষ্কং কাষ্ঠং উত্তর আসে “এই তো চলে যাচ্ছে”। কতিপয় আবার “এই চলে যাচ্ছে”-র পর আর থামতে চায় না। লম্বা লিস্ট নিয়ে শুরু হয়ে যায় – কে কত দুঃখে আছে তার ফিরিস্তি দিতে। নানা সমস্যা – রোগ, শোক, ব্যথা বেদনা, ব্যর্থ প্রেম, ভাড়াটে সমস্যা, বাড়িওয়ালার উৎপাত, শেয়ার বাজারের নাগরদোলা, আলু পটলের অগ্নিমূল্য, ই এম আইয়ের তাড়না, বাচ্চার পড়াশোনা, মেয়ের চাকরি, ছেলের বিয়ে, সোনার ভরি, অফিসে প্রমোশন নিয়ে কার্পণ্য, হাই প্রেশার, ব্লাড সুগার, হাইপার টেনশন– নানান মাথাব্যথা।

মন মাঝখান থেকে মনে মনে ফোড়ন কাটে ‘মাথা থাকলেই মাথাব্যাথাও থাকবে’। আমিও শুকনো হেসে মাথা নাড়ি আর মনকে বোঝাই যে পরেরবার প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করব। আশা রাখি দু’টি কথার, ‘ভাল আছি’।
কিন্তু পরের বারও আবার সেই “ভাল আছি আর বলা যাবে না, শরীর গতিক ভাল নয়”; যুবতী বলে, “ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে করতেই জীবন শেষ হতে চলল”; স্বচ্ছল বলে, “দু’জন রোজগার করেও আজ অব্দি হ্যান্ড টু মাউথ, ই এম আই-এর চাপে চ্যাপ্টা”; হেড অফিসের বড় বাবু বলেন “প্রমোশন দেওয়ার নাম নেই”; এমনকি তন্বীও বলে “উফ, এত মোটা হয়ে গেছি, আর পারছি না”; জড়োয়ার নেকলেস গলায় গিন্নি বলেন “এত বয়স হল, হিরের নেকলেস পড়া হল না”; টাক পড়া পঞ্চাশোর্ধ কর্তা তখন ‘ফোঁস’ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সুন্দরীর ‘স্ট্যাটিস্টিক্স’ জরিপে মজে যান।

মন বলে ‘কেন রে বাবা এত হতাশা, বেশ তো সুস্থ সবল দেখাচ্ছে, রোজগার পাতিও তো যতদূর জানি কম হয় না, মা ষষ্ঠীর দয়ায় ছেলেপুলে নিয়ে ভরভরন্ত সংসার তাহলে এত দুঃখ কিসের?’ কিন্তু, এসব কি আসলে দুঃখ? নাহ! একদম নয়। এ হল ‘অ-সুখ’। নাই “সুখ”, তাই “অ-সুখ”| সুখ খুঁজে মরছি অহরহ, কিন্তু সে মরীচিকা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় দিগন্তে। সুখ সোনার হরিণ, “তারি নাগাল পেলে, পালায় ফেলে, লাগায় চোখে ধাঁধাঁ”।

মন প্রশ্ন করেই চলে ‘সুখ কি তবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পগারপার? কেউ কি সুখি নয়? দুটো কথা ‘ভাল আছি’ – বলতে এত কুণ্ঠা কিসের?’

“সুখ? সে কি আর এ জীবনে পাব?” এক সুখ-সন্ধানি প্রশ্ন করেছিল। আমার উত্তরটা মনঃপুত হবে না জেনে তাই সেদিনও মাথা নেড়ে সেরেছিলাম। এমন সব হেঁয়ালি কি আর নিতান্তই সোজা প্রশ্নের উত্তর হতে পারে?

কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, এইরকম সব ভয়ঙ্কর হেঁয়ালিই এখন আমাদের সদা ব্যস্তময় জীবনটাকে আরেকটু ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। হেঁয়ালির জবাব খুঁজি টিভির পর্দায়, সিরিয়ালে সিরিয়ালে, রিয়্যালিটি শো’তে, বিজ্ঞাপনের রামধনুতে। গাল ভরা সব নাম, “মার্সিডিস, বি-এম-ডব্লু, লুই ভ্যিঁত, হার্মিস বার্কিন, রবের্তো কাভালি, আই পড, আই প্যাড, ব্ল্যাকবেরি, আর্মানি, ঋতু বেরি, সোনি ব্রাভিয়া, আইফেল, বার্সিলোনা, ম্যাটাডর, লাস ভেগাস” ইত্যাদি – মনে হয় তাই বুঝি সুখের ঠিকানা। স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেলে, মনের মত সব পেলেই বুঝি সুখ মেলে, না পেলেই ফক্কা – তখনই ‘অ-সুখ’। যে ধনী, যার খাওয়া পরার চিন্তা নেই, সে চায় আরও ধনী হতে| যে মানুষ দিন আনে দিন খায়, সেও চায় আকাশের চাঁদ, ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল, সিনেমায় দেখা ‘হিরো-হিরোয়িনের’-র মত জামা কাপড়, সিরিয়ালের শাশুড়ি বউ-এর মত গয়নাগাটি, পারলে একটা ন্যানো গাড়ি। গ্রাম, গঞ্জ শহর দেশ ছেড়ে এই যে পালে পালে লোক দেশান্তরী, তাও সেই সুখেরই খোঁজে।

আর কারো কথা বলে লাভ কি? আজকাল নিজেরই রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়ে, ‘উফ, আর কি পেলে মনটা বেশ খুশি থাকবে আর আমারও মনে হবে আমি সুখী?’ যেই ভাবি ‘ভালোই তো আছি’, মনে প্রশ্ন জাগে ‘সত্যি কি ভালো আছি?’। ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় খুঁজি সুখী গৃহ কোণের ছবি, নিজের ঘরের কোণা মেলাতে চাই সেই রঙে, স্বপ্নের আসবাবে, উড়িয়ে দিতে চাই রেশমি আঁচল, উড়ে যেতে চাই স্বপ্নের রাজপুত্তুরের সঙ্গে সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে| হ্যাঁ, আজকাল মাঝেমাঝে এই ‘অ-সুখ’ অসুখটা আমারও হয়।

“দুঃখ কিসে যায়? / প্রাসাদেতে বন্দি রওয়া বড় দায় / একবার ত্যাগিয়া সোনার গদি / রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায় / তবে রাজা শান্তি পায়”

 
 

হায় মুম্বই!

Read the original post on পথে প্রবাসে

সন্ধে ৬টা-সাড়ে ৬টা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসা শহরটার বুকে একটা, একটা করে আলো জ্বলে উঠছে, রাস্তাঘাটে সারা দিনের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম শেষে ঘরে ফেরার তাড়া, ভিড়। ট্রেনগুলো একের পর এক দাদার, ভি টি, চার্নি রোড, মুম্বই সেন্ট্রাল, চার্চগেট, ক্যারি রোড, কটন গ্রিন – সব স্টেশনগুলো ছেড়ে রওনা দিচ্ছে মুলুন্দ, থানে, কান্দিভেলি, বোরিভেলি, মীরা রোড, ভায়ান্দর, ভিরার – শহরটার চারপাশে ছড়িয়ে পড়া গ্রেটার মুম্বইয়ের কোণায়, কোণায়। বাস স্টপগুলোতেও উপচে পড়া মানুষ, বাড়ি ফেরার তাড়ায় বাসের নম্বর খুঁজছে উদগ্রীব চোখে। এটাই সন্ধে হয়ে আসা বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ের রোজকার পরিচিত ছবি।

১৩ই জুলাই এই অতি চেনা ছবিটা একটু ঝাপসা হয়েছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে। হঠাৎ ঝলসে উঠল ছবিটা। কিন্তু বিদ্যুতের চমকে নয়। আবার বোমা বিস্ফোরণ, একবার নয়, বারবার তিন বার, শহরের মাঝে তিন জায়গায়। জাভেরি বাজারের সরু গলি আর অপেরা হাউসের অন্ধ, কানা গলি সেদিন সন্ধ্যের ঝির ঝিরে বৃষ্টির মধ্যেও সরগরম ছিল – হঠাৎ বোমার আওয়াজ, ভয় পাওয়া মানুষের চিৎকার, আহত মানুষের কাতরানি আর মৃত মানুষের রক্ত – সব মিলে মিশে হয়ে উঠল আরেক দুঃস্বপ্নের রাত। এই হিরের বাজারের যে গলিগুলোতে দিনের বেলা রোদের আলো ঢুকতে সাহস পায় না – সেই গলির আনাচ কানাচ ভরে গেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা বোমায় ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত শরীর আর লক্ষ লক্ষ টাকার হিরের কুঁচিতে। দাদারে কবুতর খানার কাছে অ্যামোনিয়া নাইট্রেট বোমার আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাস স্ট্যান্ডটার সামনে তখন খবরের চ্যানেলের টিভি ক্যামেরা আর খাকি উর্দির ভিড়। রাত বাড়তেই এল আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি, যেন প্রকৃতিও কেঁদে উঠল মানুষের এই হিংসা দেখে, চোখের জলে মুছিয়ে দিতে চাইল অসহায় এই শহরটার বুক থেকে মৃত্যুর গ্লানি।

কিন্তু পরের দিন সকালবেলা মুম্বইয়ের সেই পুরনো রূপ। ভোর থেকে রাস্তায় দুধওয়ালা, কাগজওয়ালাদের সাইকেলের টিং টিং, বাজার সরগরম বাজারুদের দরদামে, বাসে ট্রেনে আগের দিনের চেয়ে বুঝি একটু বেশি ভিড়। যদিও চেনা হিরে পট্টি সেদিন শুনশান, জাভেরি বাজার আর অপেরা হাউসের রাস্তায় খাকির ভিড় বেশি, তখনও কিছু সাংবাদিক ঘুরছে ‘এক্সক্লুসিভ’ নিউজের লোভে। দাদারে বিস্ফোরণের প্রকোপ ছিল কম তাই সেখানে কৌতূহলীদের ভিড় বেশি। ব্যাস, এই পর্যন্তই।

নাহ, এবার আর কোন অযথা শোক প্রকাশ, কোনও পথসভা, কোনও মিছিল, মিটিং, এক মাইল লম্বা পোস্টার লিখন, গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায় মোমবাতি জ্বালিয়ে শোক সমাবেশ, কিচ্ছু হল না। অবাক হলাম বেশ। রাত কাটার সাথেই মুছে গেছে গত রাতের দুঃস্বপ্ন? এই কি মুম্বইয়ের সেই ‘স্পিরিট’? যা কিছুই হোক না কেন, ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ে মুম্বই, চলতে শুরু করে আবার নিজের তালে, মুহূর্তে কাটিয়ে ওঠে শোক। জীবন যুদ্ধে সামিল হয়ে আবার! নাকি প্রাণহীন এই শহর আর এই শহরের মানুষগুলো?

কেউ বলল, “এখানে মানুষরা বড় স্বার্থপর। কটা লোক মরেছে বলে কারোর কিছু আসে যায় বলে তো মনে হয় না”

আরেক জনের বক্তব্য, “যেখানে দিনে দুপুরে আন্ডার ওয়ার্ল্ডের গুলির নিশানা হয় মানুষ,  ফাইভ স্টার হোটেলে ঢুকে টেররিস্ট গুলি চালিয়ে লোক মারে, ঠগ জোচ্চোরে রাজ্য ভরে গেছে, এত কোরাপশন – সেই শহরের বাসিন্দারা যে স্বার্থপরের মত মুখ ঘুরিয়ে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কিসের? ওই মরা মানুষগুলোর সাথে শহরটাও মরতে বসেছে”

“১৩ই জুলাই, ১৩/৭ ইতিহাসের পাতায়ে আরেকটা কালো দাগ মাত্র। ২৬/১১-এর পর লাইন লাগাল ১৩/৭, এর পর নতুন কোন তারিখ বসবে কে জানে?”

“আরে বাবা, এটা তো আর আমেরিকা নয় যে আমাদের প্রেসিডেন্ট আতঙ্কবাদের বিরুদ্ধে, সারা তৃতীয় বিশ্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেবে, অন্য দেশকে মিথ্যা ফাঁসিয়ে মিসাইলের ঝড়ে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। এ হল মুম্বই, বলিউডের ক’জন নায়ক নায়িকা মোমবাতি হাতে জড় হবে গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়ায়, জ্বালাময়ী ভাষণ দেবে! ব্যাস, সব ঠান্ডা। আবার কদিন বাদে আবার কোনও অলি গলি, বাজারে, স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে আবার ফাটবে বোমা, মরবে কটা নিরীহ মানুষ আর তারপর  মুম্বই আবার ধুলো ঝেড়ে উঠে ফিরে যাবে নিজের তালে।

তাহলে সত্যিই কি এই স্বপ্নের নগরী, এই বাণিজ্য নগরী প্রাণহীন, পাষাণ? সত্যি কি এখানকার মানুষ এতটাই স্বার্থপর, যে এমন ভয়াবহ মৃত্যুও তাদের নাড়া দিতে পারে না?

কিন্তু, একবার কি ভেবেছেন তাদের কথা? ওই যে ওরা, যারা রোজ সকালে দশ ফুট বাই দশ ফুটের ‘চওল’-এর ঘরটা ছেড়ে তিনটে ট্রেন পালটে ওই জাভেরি বাজারে বা অপেরা হাউসের আশে পাশে ছোট ছোট কাজ করে, বা যারা দিন মজুর বা ওই স্পটবয়টা, রোজ হাজার ওয়াটের আলোয় কোটি কোটি টাকার সিনেমা রোশনাই করে, সেই দোকানদাররা যাদের জীবনের মূলধন দেওয়ালের গায়ে লাগান ছোট্ট টিনের ঘরটা বা ঠ্যালাটা, যে লোকটা রোজ অটো চালিয়ে নিজের সংসারের পেট চালায় আর হপ্তা দিয়ে হাবিলদারের পেটও ভরায়, তাদের কথা। মুম্বই মানে তো এরাই, ৭৫% এই সব মানুষ, ভোর থেকে রাত অব্দি যারা অবিরত ব্যস্ত পেট ভরার তাগিদে।

এই মানুষগুলোর দিন আনা দিন খাওয়ার রোজনামচায় ছেদ পড়া মানে  একদিনের রোজগার বন্ধ। সন্ত্রাস তো তাদেরই ভাতের হাঁড়িতে। আজ বেঁচে আছে, কাল অন্য কোনও গলির বাঁকে, অজানা কোনও বাস স্টপে লুকানো বোমের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হতেই পারে। এই মানুষ গুলিই তো প্রতিবার মুখ  থুবড়ে পড়ে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, ধুলো ঝেড়ে, ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলতে আরম্ভ করে। আর তো কোনও উপায় নেই। ভয় পেয়ে পেয়ে আজ তারা তাই ভাবলেশহীন, ভয় শূন্য, হতাশ হতে হতে তারা পাথর। পেটের তাগিদে তাড়িত, আঘাতে জর্জরিত মুম্বই আর আশা করে না যে আমূল ভাবে কোনও কিছু বদলাবে। আপিলও করে না বা নালিশও করে না প্রশাসনের কাছে এই দুরবস্থা নিয়ে। জানে যে ‘এই ভাবে আর কতদিন সন্ত্রাসের শিকার হব’? প্রশ্নটার কোনও উত্তর নেই। রোজ বোমার আঘাতে মৃতদের দাহ করতে করতে মুম্বই আজ নিঃসাড়, নির্লিপ্ত। শিখে গেছে আজ মৃত্যুর সঙ্গে পথ চলতে।

 
 

‘পরিবর্তন’, কেবলই একটি বিশেষ্য

Read the original post on পথে প্রবাসে

সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে, বাইরে অন্ধকার নেমেছে অন্য দিনের চেয়ে একটু আগেই। মেঘলা আকাশ, দূরের ঝিল আবছায়া, কিন্তু বারান্দা পেরিয়ে, দরজা ডিঙিয়ে আজ চাঁদের হাট বসেছে আমার ঘরে। আমার পতিদেব সমেত চার তার্কিক ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে তুফান তুলেছে।

সোফার কোণে বসে চুপচাপ শুনছিলাম নানা যুক্তি তর্ক, পরিবর্তনের পক্ষে, বিপক্ষে। পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী, পরিবর্তনশীল সমাজের গতি রোধ করা অসম্ভব, কেন চাই পরিবর্তন, কারা পাল্টাচ্ছে, কারা পালটাতে ভয় পায় – নানা কথা, নানা মত।

শুনতে শুনতে, কখন কে জানে, আমি পৌঁছে গেলাম আমার ছোটবেলার সেই দিনগুলোতে। মধ্য কলকাতার অলি গলি তস্য গলির মাঝে ছিল আমার পাড়া । গরম কালে, সন্ধে বেলায় ঠিক এরকম সময়ে কি সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া বইত, রাতে ঝুড়ি বোঝাই জুঁই ফুলের মালা নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফিরত ফুলওয়ালা, দোতলার বারান্দার কোণায় বসে আমার ঠাকুর্দা এক মনে শচীন কর্তার গান শুনতেন, মাঝে মাঝে কাকার ঘর থেকে ভেসে আসত সরোদের মিঠে সুর, জানালায় দুলতে থাকা পর্দার ছায়ায় আমি দেখতাম দত্যি দানবের লড়াই| আর কখন তারপর রাতের কোলে মাথা রেখে হারিয়ে যেতাম সাত সমুদ্র তেরো নদীর কূলে, পক্ষীরাজ ঘোড়ায় সওয়ার রাজপুত্তুরের দেশে। তখনও, সেই ফ্রক পরা, ঝুঁটি বাঁধা পাঁচ বছরের মেয়েটা – আমি – আনচান করতাম বড় হব, পালটে যাব বলে। মন ছটফট করত কবে ফ্রক ছেড়ে ওড়না ওড়ানো সালোয়ার কামিজ পড়ার জন্যে| লম্বা চুলে বেণী বাঁধব, আমার চেয়ে বয়সে বড় দাদা দিদিদের মত চোখে চশমা এঁটে মোটা মোটা বই ঘাঁটব, কবে মা আর দুধ খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করবে না – এই রকম নানান গুরুত্বপূর্ণ ‘পরিবর্তন’-এর জন্য।

কিন্তু সেই বয়সে কল্পনাও করতে পারিনি আসলে পরিবর্তন কাকে বলে। আমি জানতাম আমাদের বারান্দার সামনে পাহাড়ের মত বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বনেদি মল্লিকবাড়ির ছাদের ওপারে চিরকালই লুকিয়ে থাকবে আকাশটা| আমার ঠাকুরদা রোজ বিকেলেই ঠাকুমার সঙ্গে চা, মুড়ি, চিনেবাদাম খাবেন আর রাতে বারান্দায় বসে পেসেন্স খেলবেন শচীন কর্তার গান শুনতে শুনতে, প্রতি শনিবার সন্ধে হলেই মা বাবার সঙ্গে সিনেমা যাবে, আমার কাকা সরোদে নতুন নতুন সুর তুলবে, বর্ষা হলেই গলির মোড়ে এক হাঁটু জল জমবে| পাশের বাড়ির ম্যাও দাদু চিরকাল তাঁর বিলেতে থাকা ছেলের গল্প শোনাবে আর শেষ বয়সে তার কাছে বিলেতে থাকার স্বপ্ন দেখবে, হরিদাদা রোজ ভার ভার জল তুলে আমাদের চৌবাচ্চা ভর্তি করবে। আমি জানতাম, আমি বড় হলেও আমার চারপাশে কোনও কিছু বদলাবে না, অলস বড় রাস্তাটা ধরে এমনই রোজ স্কুলে যেতে হবে, এমনকি নতুন আসা টেলিভিশনটাও সাদা কালোই থেকে যাবে।

হঠাৎ একটা কথার টানে এক দৌড়ে ফিরে এলাম বাস্তবে, আমার প্রবাসের ড্রয়িং রুমে। এক তার্কিক তাল ঠুকে বলল, “আসলে আমরা পরিবর্তনকে ভয় পাই, তাই বদলাতে চাই না আমরা। আর বাঙালিরা তো জগদ্দল পাথরের গায়ে শ্যাওলার মত জমে আছে, তারা ‘পরিবর্তন’ নামের বিশেষ্যটির সংজ্ঞা ভুলে গেছে”।
তর্কের এই অ্যাঙ্গেলটার সঙ্গে এক মত হতে পারলাম না। গত তিন দশকে কত কিছুই তো পালটাল আমার সামনে। আমার ঠাকুরদা রেকর্ড প্লেয়ার আর রেডিওর মায়া ত্যাগ করে ধরলেন টিভি। ছোটবেলার সেই অজগরের মত এলিয়ে পড়ে থাকা সেন্ট্রাল এভিনিউকে ক্ষত বিক্ষত করে, বুকে পিলার ঠুকে ঠুকে কলকাতার পাতালে চলতে শুরু করল রেল, দলবদলের বোমাবাজিতে মাতোয়ারা হল অলি গলি, রাস্তার মোড়, ইংরেজির হল ডিমোশন, ভিড়ে ভরে উঠল শহর, সাদা কালো থেকে বাড়ির টিভিটাও একদিন হয়ে গেল রঙিন। আর আমি? ঝুটিঁ থেকে বিনুনিতে প্রমোশন পেলাম আর মোটা, মোটা বইয়ের মাঝে হারিয়ে গেলাম।

এত কিছুর পরেও কি করে বলি যে বাঙালি বদলায়নি? কে বলে যে বাঙালি পরিবর্তন চায় না? দলে দলে শহর, গ্রাম উজাড় করে এই যে আমরা দেশে, বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছি, কেন? মাত্র বছর কুড়ি আগেও যে ঠোকাঠুকি, চুলোচুলি, ঝগড়াঝাঁটির এক্কান্নবর্তী সংসার ছিল, তা আজ ‘ছোট পরিবার, সুখী পরিবার’ হয়েছে, কেন? বড় দোমহলা বাড়ির বিলাসিতা ছেড়ে আজ সবার কাম্য ‘টু বেডরুম, ডাইনিং, হল, কিচেন’ – কেন? পুরোনো, প্রাসাদোপম বাড়ি, বাজার ভেঙে চাই অত্যাধুনিক ‘মল’, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর| চওড়া রাস্তার বুকে গজিয়ে তুলি উড়ালপুল – কেন? বাঙালি মতে সাতপাকে বেঁধে, অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে তো হবেই, তার আগে চাই পাঞ্জাবি ‘মেহেন্দি’ আর ‘সঙ্গীত’-এর জলসা| এসব পরিবর্তন নয়? হেমন্ত, মান্না, শ্যামল, সন্ধ্যা, আরতি ছেড়ে আমরা শুনি জীবনমুখী গান। সত্যজিৎ, ঋত্বিক ঘটক ছেড়ে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘পাগলু’-র রসে মজে যাই। এসবও আমূল পরিবর্তন।

হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের ‘পরিবর্তন’-টা হয়েছে উন্নতির বিপরীতে, আবার অনেক সময় আমাদের এই বদলান চাল-কে নিন্দুকেরা নাম দিয়েছ ‘যত্ত সব অপসংস্কৃতি’।না হয় জাতি হিসেবে আমরা সামনের সারি থেকে পিছতে, পিছতে একেবারে পিছনের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছি।

আমরা “হ্যাঁ” বলতে গিয়ে না হয় বলে ফেলি “না”। হয়তো‘পরিবর্তন’ কথাটা আমাদের চিন্তায় ফেলে দেয়, ভয় দেখায়। তারপর সেই দুশ্চিন্তা নেয় অনীহার চেহারা। জাতিগত উন্নতির কথা হয়ত ভাবতাম একদিন আমরা, সেই চিন্তাও আমরা পালটে ফেলেছি। আজ আমরা ভাবি,‘কি হবে বদলে, কিছুই তো পালটাবে না’। তাই বলে পরিবর্তন আমাদের হয়নি ভাবাটা ভুল। পোশাকে আশাকে, আসবাবপত্রে, ঘর বাড়িতে, চুলের ছাঁটে, কথার ঢঙে, সামাজিক রীতি নীতিতে– প্রচুর পাল্টেছি নিজেদের। এবার শুধু ‘পরিবর্তন’ নামক বিশেষ্যটি ক্রিয়া রূপে দরকার নিজেদের কিছু চিন্তা ভাবনায়। তাই না?

 
 

আ মরি বাংলা ভাষা

১৯৯৮ সাল। দিল্লির গ্রীষ্মের গনগনে দুপুর গড়িয়ে কখন জানি বিকেল হয়ে এসেছে। বাইরে যদিও বেশ রোদ্দুর। চিত্তরঞ্জন পার্কের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি গত দু’মাসে দিল্লিতে পাতা নতুন সংসারের হিসেব নিকেশ নিয়ে একটু অন্যমনস্ক। একতলার গেটের সামনে থেকে কে যেন বলল, ‘‘কাল তোমাদের দরজার তলা দিয়ে একটা চিটঠি ডেলে দিয়েছিলাম, পেয়েছিলে?’’ গলার মালিক আমাদের তিনতলার প্রতিবেশী বসু-বাবু পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘‘চিটঠিটা ডেলেছিলাম, মিলেছে তো?’’ মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম, কিন্তু মগজের খাঁজে খাঁজে, ‘ডেলেছিলাম, চিটঠিটা, মিলেছে’ কথাগুলো বঁড়শিতে গাঁথা মাছের মত খাবি খেতে লাগল।

বসু-বাবুর বাবা দেশভাগের সময়ে বাংলাদেশের কোনও নগর বা গ্রাম থেকে তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে এসেছিলেন রাজধানী দিল্লির এই দক্ষিণ কোণায়, ইস্ট পাকিস্তান ডিস্প্লেসড পিপলস এসোসিয়েশনের উদ্বাস্তু কলোনিতে। সঙ্গে বাংলা ভাষাটাও এনেছিলেন বলেই বিশ্বাস ছিল আমার। তাই খাবি খাওয়া মনকে থামিয়ে বোঝালাম যে বসু সাহেব কন্ট্রাক্টর মানুষ, সারাদিন মিস্ত্রি মজুর খাটান। তাই বোধহয় তাঁর ভাষার মাধুর্য ইঁট কাঠ পাথরের তলায় চাপা পড়ে গেছে। নাহলে কি কেউ স্বেচ্ছায় নিজের ভাষা ভুলে যায়?

কিন্তু ক্রমে ক্রমে বাজারে, দোকানে, পাড়াতে, নতুন পাওয়া বন্ধুদের মুখে নিত্য নতুন নানা কথা কানে আসতে লাগল। “ইনি আমার বাবা হচ্ছেন”; “কবুতর গুলো বহুত শয়তান আছে”; “নৌটঙ্কি করিস না তো”; “ইলিশ মাছটা আজ খুব টাটকা হচ্ছে” ইত্যাদি, শুনতে শুনতে আমার কিছু ভুল ধারণা ভাঙল, আর কিছু নতুন জ্ঞান প্রাপ্তিও ঘটল। প্রথম ভুল ধারণা- বাংলা মাতৃভাষা বলেই যে তাকে মায়ের মত করে আঁকড়ে থাকতে হবে, তা বেশির ভাগ বাঙালির বাইবেলে লেখা নেই। সে স্বদেশেই হোক কী প্রবাসে‌!

বাঙালিদের ‘ঘেটো’ চিত্তরঞ্জন পার্ক ফেলে যখন উঠে গেলাম গুরগাঁও-এর এক আকাশচুম্বী বাড়িতে, লিফটে দুই প্রতিবেশী বাঙালির কথোপকথনে আড়ি পেতে হল জ্ঞান প্রাপ্তি। এক ভদ্রলোক, সম্ভবত মধ্য কলকাতার বাসিন্দা, শুধালেন “আরে ইয়ার, মুখার্জি সাহাব! কাঁহা হো আপ আজ কাল?” মুখার্জির জবাব এলো “ম্যাঁয় তো ইধার হি হুঁ, আপ কা হি দর্শন নহি মিলতা হ্যায়।” বাংলার বাইরে পদার্পণ করে কতিপয় বাঙালি বাংলা বলতে লজ্জা পায় জেনে সেদিন বোধহয় আশ্চর্যই হয়েছিলাম। মধ্য প্রাচ্যের মরু শহরে সংসার পাততে গিয়ে আলাপ হল অন্য এক বাঙালির সঙ্গে। তাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ দুর্গা পুজোর আসরে। মনে হয়েছিল, তারা বুঝি মারাত্মক ভাবে বাঙালি – ভেদাভেদ ভুলে সব গলাগলি করে রয়, আর কথায় কথায় দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আওড়ায়। পয়লা বৈশাখ, পঁচিশে বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, বিজয়া সম্মিলন – কারণে অকারণে রবীন্দ্র নৃত্য, শ্যামা সঙ্গীত, ডি এল রায়ের নাটক, ভূমির জীবনমুখী গানে ছয়লাপ হত ইন্ডিয়ান কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের কমিউনিটি হল। এত পর্যন্ত ঠিকই ছিল। আমিও ভাবতে শুরু করলাম যে, স্বদেশের পরবাসে যে বাঙালি, যে বাংলা ভাষার জন্য মন আকুল হত, এই ঘোরতর বাঙালিদের সান্নিধ্যে বুঝি তা পূরণ হবে।

কিন্তু, হায় রে বাঙালিনির মন! যে বাঙালির মুখে এত পদ্য, এত গানের ফোয়ারা তাদেরই সঙ্গে সুপার মার্কেটে দেখা হলে ‘হাই, হাউ আর ইউ?’; ডিনারে দেখা হলে, ‘নাইস টু মিট ইউ!’ আর কোন পার্টিতে দেখা হলে, ‘ক্যান আই হ্যাভ দিস ডান্স উইথ ইউ?’ সব চেয়ে আশ্চর্য হয়ে যেতাম বাঙালির ছেলেমেয়েদের দেখে। এদিকে কেমন চোখ গোল গোল করে, মাথা দুলিয়ে, দুলিয়ে “শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে” বলে স্টেজ কাঁপাচ্ছে, অথচ স্টেজ থেকে নেমে মা বাবা, বন্ধু বান্ধবদের মাঝে বাংলার ‘ব’ পর্যন্ত উচ্চারণ করছে না। জিজ্ঞেস করে মায়েদের থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব উত্তর পেতাম। ‘ছেলে মেয়ে গুলো এতদিন দেশ ছাড়া বলে বাংলা ভুলে গেছে রে’; ‘নাহ রে, বাংলা শিখতেই চায় না আজকালকার বাচ্চারা’; ‘ওই তো জোর করে কবিতাটা ইংরেজিতে লিখে দিলাম বলে তো মুখস্থ করে বলতে রাজি হল’; ‘বাংলা শিখে কি হবে আর?’ কালে কালে বেশ বুঝলাম, যে বেশির ভাগ বাঙালি-ই বাংলার চৌহদ্দি পেরলেই বাংলা ভাষাটাকে পুরোনো ঘরে ফেলে আসা আসবাবের ঝুলধরা তাকের কোণে তোবড়ানো টিনের বাক্সে বন্দি করে আসে। সঙ্গে আনে ‘আমি বাঙালি’ নামক তকমা, যদিও তা হাতির দাঁতের মত শুধুই বাহারি। আসলে বাংলা ভাষা যেন কেবলই ফাঁকা আওয়াজ! তোতার বুলি! মুখস্থ বিদ্যা! একদিন তো একজন বন্ধুকে বলেই বসলাম, ‘কদ্দিন হল নর্থ ক্যালকাটা ছেড়েছ? এর মধ্যেই বাংলা ভুলে গেলে?’
মাত্র দু’ সপ্তাহ আগের ঘটনা। কলকাতায় বসে রেডিও শুনছিলাম। এক আসন্ন বাংলা ছবির গান বেজে উঠল, ‘জানেমন, জানেমন …’। চমকে উঠলাম – কলকাতায় কি সংসদের অভিধান ছাপা বন্ধ হয়ে গেছে? নাকি সময় এল অভিধানে নতুন নতুন কথার মানে লেখার? এবার কি ইংরেজির মত বাংলাও মেলবে মুক্তির ডানা? শক্ত বানান, যুক্তাক্ষর ভুলে সব হবে সোজা, সরল, সাদা? নবাবি আমলে বাংলা ভাষার অনেক ভাঙা গড়া হয়েছিল। ঢুকে পড়েছিল ‘কুর্শি’, ‘দরজা’, ‘পেয়ালা’, ‘শরবত’ ইত্যাদি অনেক আরবি, ফার্সি শব্দ। এবার কি বেনো জলের মত ঢুকে পড়বে হিন্দি, ইংরেজির, ‘জানেমন’, ‘চিপকলি’, ‘মজাক’, ‘নউটাঙ্কি’, ‘ড্রামাবাজি’,-র মত শব্দ? স্বদেশে, পরদেশে, প্রবাসে বাঙালিদের মুহূর্তে বদলে যাওয়া মতিগতির সঙ্গে, পলে-পলে পালটে ফেলা টিভি চ্যানেলের এর মত ‘মেড ইজি’ করতে কি বাংলা ভাষা এবার দোর খুলে দেবে অভিধানের? হবে নাকি, নতুন ভাষার নতুন কথার, নতুন নতুন মানে? ভবে ভোলা বাঙালি কি বাংলা ভাষাকে নব কলবরে ফিরিয়ে আনবে জগৎ সভায়? কোনও দিন কি আমার মত ‘তালিবান মনস্ক’ যারা, তারা খুঁজে পাব সেই ‘সব পেয়েছির’ দেশ, যেখানে বাঙালি ইংরেজি হরফে রবীন্দ্রকাব্য না পাঠ করে জন্ম দেবে আরেক নতুন রবির!

 
 
 
%d bloggers like this: