পয়লা বোশেখ
কালকের পয়লা বৈশাখ অতীতের কিছু পয়লা বৈশাখের স্মৃতি হঠাৎ তাজা করে রেখে গেছে। আজ দোসরা বৈশাখ, ১৪১৯, রবিবার। সকাল থেকে মন সেই স্মৃতি চারণে মশগুল। ব্লগের পাতায় তুলে দিলাম তারই কিছু মুহূর্ত।
চৈত্র মাসের শেষ দিনটা আমি ছোটবেলায় কোনদিন বাড়িতে কাটিয়েছি বলে তো মনে পড়ে না। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেই ছুটির ঘণ্টা বাজার তর সইত না। বেল বাজলেই সব্বার আগে ক্লাস ছেড়ে দৌড়।
মামারবাড়ির পাড়ায় স্কুল হওয়ার এটাই মজা। কোনো না কোন ছুতোতে বা বিনা কারণেই রোজ একবার করে ঢুঁ মারা যায়। তবে চৈত্রের শেষ দিনে, মুচিপাড়া থানার গোলাপ শাস্ত্রী লেনের লম্বা রকওয়ালা দোতলা বাড়িটার প্রতি টানটা একটু বেশিই হত। সদর পেরিয়ে, একতলার বৈঠকখানার স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারটা চট করে পিছনে ফেলে উঠে এক দৌড়ে উঠে যেতাম দোতলায়। সেদিন আর ভাত খেয়ে ঘুম পেত না, বিকেলে ছাদটাও ডাকত না, জানালার নিচে আইসক্রিমওয়ালা হেঁকে গেলেও কানে যেত না, লেবুতলা পার্কের আলুকাবলিওয়ালাটাকেও সেদিন মনে পড়ত না।
মামারবাড়ির দোতলার খাবার ঘরে তখন ঘটনার ঘনঘটা। এক কোণে সুতোর রিল, শোলার কদমফুল, আমপাতা আর এক ঝুড়ি গাঁদাফুলের মালা। টেবিলের ওপর দিদার হাতে রাঁধা নারকেল দেওয়া ভাজা মুগের ডাল, কচি পটল ভাজা, ভেটকি মাছের কাঁটা দিয়ে ছ্যাঁচড়া, চিংড়ি মাছের মালাইকারি ইত্যাদি। মান্ধাতার আমলের ফ্রিজটার পাশে বড় বড় চাঙ্গাড়ি – হলুদ সেলোফেনে ঢেকে, গোলাপি সুতো দিয়ে বাঁধা। পাশে একতাড়া কাগজের খোলা বাক্স।
পেটপুজো শেষে শুরু হত দক্ষযজ্ঞ।
আচ্ছা, মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি ভরা যে বাক্সগুলো আসে, তার রহস্য জান কি? ভাঁজে ভাঁজে মুড়ে, খাজে খাঁজ মিলিয়ে, খাপে খাপে বসিয়ে মিষ্টির বাক্স বানিয়েছ কোনদিন? ঠিক অরিগামির হাঁস, বক বা ফুল বানানর মত, তাই না? আমাদের কাজ শুরু হত ওই বাক্স বানান দিয়ে। নজর যদিও বাক্সের উপর থেকে সরে, বারে বারে চলে যেত ঘরের কোণে রাখা চ্যাঙ্গারীগুলোর দিকে – যার হলুদ সেলফেনের নিচে গা ঢাকা দিয়ে আছে ভীম নাগ ময়রার দরবেশ – জাফরানি আর লালচে নরম বোঁদের নাড়ু, উপরে শুকনো ক্ষীরের পরত – মন কি আর শূন্য বাক্সে বেশিক্ষণ বসে? বাক্স তৈরির শেষে, দিদা হাতে ধরাত আমপাতা আর শোলার কদমফুলের তোরণের কাজ। তা শেষ করতে পারলেই দরবেশ চাখার সুযোগ। আর বিকেলে চায়ের সাথে রামপদ রায়ের সিঙ্গারা। রাতে দিদার হাতে পরটা না হলে পেটই ভরত না। আর তারপর রাতভর ভোরের অপেক্ষা। টাটকা গাঁদাফুলের মালাগুলোও অজগরের মত প’ড়ে থাকত ঝুড়িতে, কাল সকালের অপেক্ষায়।
পরদিন কাকভোর থেকেই সরগরম একতলার বৈঠকখানা। হাওড়া হাট থেকে আসত আরও বাহারি ফুল, মিষ্টির দোকান থেকে ক্যানেস্তারা ভরে আসত টাটকা, গরম, খাস্তা নিমকি, চাঙ্গাড়ি ভরা ভীম নাগের “শুভ নববর্ষ” সন্দেশ, গরমাগরম সিঙ্গারার ঝুড়ি – ঘেমো মুটেগুলো যে যার ক্যানেস্তারা, চ্যাঙ্গারী নামিয়ে নানা সুরে”নয়া সাল”এর বকশিসের আবদারে জুটে যেত।
এতো তোড়জোড় কিসের? কেন, পয়লা বোশেখে দাদুর দোকানের হাল খাতার পুজোর জন্য। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির পাড়ায় সেদিন বিশাল দোকানটায় টেবিল চেয়ার সরিয়ে, ঝাড়পোঁছ করে, ধুয়েমুছে, এক কলি চুনকাম চড়িয়ে, নতুন শতরঞ্চি পেতে সাজানো। সামশেরদাদা দেওয়ালে মালা সাজাতে, কাশেমদাদা দরজার মাথায় কদমফুল আর আমপাতার তোরণ লাগাতে আর এক কোণে মামারবাড়ির পুরোহিত আসন পেতে পুজোর আয়োজনে ব্যাস্ত। লাল হালখাতার প্রথম পাতায় সিঁদুর মাখা রুপার টাকার ছাপ পড়ত, চুনকাম করা দেওয়ালে নতুন করে আঁকা হত তেল সিঁদুরের সিদ্ধিদাতার স্বস্তিকা। ধুপ ধুনোয় ভরে যেত ঘর। আর তারপর সারা সকাল বৌবাজার পাড়ার লোকজনেদের মিষ্টির বাক্স বিলানো।
আমার স্মৃতিজড়িয়ে আছে সেই কদমের তোরণে, মন প’ড়ে আছে তাজা চুনকাম করা দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে, নতুন পাওয়া জামাগুলোর সরল আনন্দে, রাতে দিদার হাতে লুচি মাংসে আর প্রতি পয়লা বৈশাখের হালখাতার প্রথম পাতায়।
picture courtesy : inmagine.com
একুশে আইন – revisited
শিব ঠাকুরের আপন দেশে,
আইন কানুন সর্বনেশে!
কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে,
পেয়াদা এসে পাকড়ে ধরে —
কাজির কাছে হয়ে বিচার,
একুশ টাকা দণ্ড তার ।।
সেথায় সন্ধে ছ’টার আগে
হাঁচতে গেলে টিকিট লাগে —
হাঁচলে পরে বিন টিকিটে —
দম দমা দম লাগায় পিঠে,
কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে —
একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে ।।
কারুর যদি দাঁতটি নড়ে,
চারটি টাকা মাশুল ধরে,
কারুর যদি গোঁফ গজায়,
একশো আনা ট্যাকশো চায় —
খুঁচিয়ে পিঠে গুঁজিয়ে ঘাড়,
সেলাম ঠোকায় একুশ বার ।।
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,
এদিক, ওদিক, ডাইনে, বাঁয়ে,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়,
একুশ হাতা জল গেলায় ।।
যে সব লোকে পদ্য লেখে,
তাদের ধ’রে খাঁচায় রেখে,
কানের কাছে নানান সুরে,
নামতা শোনায় একশো উড়ে —
সামনে রেখে মুদির খাতা–
হিসেব কষায় একুশ পাতা
হঠাৎ সেথায় রাত দুপুরে,
নাক ডাকালে ঘুমের ঘোরে,
অমনি তেড়ে মাথায় ঘষে,
গোবর গুলে বেলের কষে,
একশোটি পাক ঘুরিয়ে তাকে
একশো ঘণ্টা ঝুলিয়ে রাখে।।
একা এবং সোশাল-নেটওয়ার্ক
একটা লেখার ঝোঁকে অনেকক্ষণ জেগে আছি আজ, কখন যে মাঝরাত গড়িয়ে গেছে হুঁশও হয়নি। বাকি সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, সারা বাড়ি নিঝুম। জানালার বাইরে মধ্যরাতের শহরটা রাতের আকাশের মত অন্ধকার, আশপাশের বাড়িগুলো অন্ধকারের ঘোমটা টেনে ঘুমিয়ে পড়েছে, জেগে আছে শুধু রাস্তার দুধারের নিওন বাতিগুলো। নীচে রাস্তায় কমে গেছে গাড়ির ভিড়, সেই সুযোগে নেড়ির দল সরু গলি ছেড়ে বড় রাস্তা দখল করতে নেমেছে, তাদের চিৎকার মাঝে মাঝে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে রাতের নীরবতাকে। আর শুধু একটা দুটো দলছুট অটোরিকশা রাতের সওয়ারির খোঁজে এখনও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে।
ঘরের আধো অন্ধকারে আমার নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে টেলিভিশনটা মিউট করে চালানো। এদিকে মগজের অবস্থা “খাচ্ছে, কিন্তু গিলছে না” – লেখাটা এক জায়গায় এসে থেমে গেছে – মনও আর বশে নেই, সেও উড়ি উড়ি, এই সময়ে আর লেখায় বসবে না।
আমি কম্পিউটারের ওয়ার্ড ডকুমেন্টটা বন্ধ করে ইন্টারনেটের ব্রাউসারটা খুললাম। অভ্যাসবশত ফেসবুক আর টুইটারে লগ ইন করে চোখ গেল স্ক্রিনের কোনায় ঘড়ির দিকে – রাত দুটো! কিন্তু ল্যাপটপের এল সি ডি স্ক্রিনের ওপারে দেখি এখনও বয়ে চলেছে এক সমুদ্র নিস্তব্ধ কথার স্রোত। পূর্ব গোলার্ধের বেশিরভাগ মানুষই যখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, কিছু নিশাচর তখনও জেগে। তবে শুধু জেগে থেকে ক্ষান্ত নয় তারা, পুরদস্তুর আড্ডার আসর চালিয়ে যাচ্ছে নিজেদের মধ্যে, কেউ আড়ি পাতছে অন্যের কথায়, কেউ বা ঝগড়ায় ব্যস্ত, কেউ ব্যস্ত নিজের কবিতা পড়তে, একজন ব্যস্ত নিজের সাম্প্রতিক ফরেন ট্রিপের অ্যালবাম ফেসবুকে লাগাতে, তো অন্যজন ব্যস্ত অচেনা ফেসবুক বন্ধুর জীবনের ঘনঘটা ভরা অ্যালবাম থেকে তাকে একটু চিনতে। টুইটারে বয়ে চলেছে তর্ক-বিতর্কের ঝড়, রাতজাগা এক সুন্দরীর ব্যর্থ প্রেমের প্রলাপ, বিশিষ্ঠ এক ফিল্মস্টারের ফিলসফি ক্লাস, সিনেমার সমালোচনা, রাজনিতি, কূটনীতি, রান্নাবান্না, লেখকের স্মৃতিচারণ, স্কচ, রাম, জিনের ফোয়ারাও। আজ মাঝরাতে জেগে থেকে এক নতুন জগতের হদিস পেলাম।
মন শুধালো, ‘আচ্ছা, এদের পাশের মানুষগুলো কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে, নাকি এরা সবাই একা, অবিবাহিত, পিজিতে বা হস্টেলে থাকা কম বয়সী ছেলে মেয়ে? ঘর ছেড়ে দূর শহরে চাকরি করে বুঝি? এদের ঘর বাড়ি নেই, সংসার নাই, কাল সকালে উঠে অফিস যেতে হবে না, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে হবে না? এত রাতে এরা জেগে আছে কেন? এদের ঘুম পায় না বুঝি, ইনসমনিয়াক?’ বাতুল মনকে দেবার মনের মত কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না।
আধুনিক নগর-সভ্যতার অভিশাপ আর জরা-ব্যাধি-মড়ক নয়, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, অদৃশ্য এক শত্রু, একাকীত্ব। নিঃসীম সমুদ্রে ভেসে বেড়ান দ্বীপ আমরা। দিনভর কেরিয়ারের দাসত্ব, ই এম আই, স্কুল ফি, গাড়ির লোন, সংসারের নানা মাথাব্যাথা। ফুরসৎ কথাটা বাংলা-ঈংলিশ মোটা ডিকশনারির পাতার মাঝে হারিয়ে গেছে। বন্ধু আছে, কিন্তু সময় নেই। আবার কখনো সময় থাকলেও মনের মত বন্ধু থাকে না। বন্ধু থাকে তো মনের মানুষ পাওয়া যায় না। যেন আমরা প্রতি পল আরও একটু বেশি নিঃসঙ্গ, আরও একা হয়ে পড়ছি। মানুষের একাকীত্বের কি কারণ? নানা মুনির নানা মত। এই একটা অসুখ আমাদের প্রতি নিয়ত গ্রাস করে চলেছে, কিন্তু তার কোন ওষুধ খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনও।
আজ মাঝরাতে ব্রাউসারের পাতায় পাতায়, ফেসবুকের আপডেটে, টুইটারের টাইমলাইনে, অর্কুট, মাই স্পেস, গুগুল প্লাস, পিন্টারেস্ট- এর মত “সোশাল নেটওয়ার্ক”এর দেয়ালে দেয়ালে দেখলাম নিদ্রাহীন, স্বপ্নহীন এক জনস্রোত – নানা জন, প্রচুর কথা, হাজার প্রশ্ন, মান-অভিমান, ভাব, ভালবাসা, হিংসা, ঝগড়া – ঠাণ্ডা স্রোতের মত নীরবে বয়ে চলেছে ঠাণ্ডা কাঁচটার ওপারে – একাকীত্বের নিঃশব্দ কোলাহল। সে জগতে কেউ ঘুমোয় না, কেউ স্বপ্নও দেখে না। এত কথার, এত আওয়াজের মাঝে শুধু একটা কথাই শুধু সবাই নিঃশব্দে চিৎকার করে বলে চলেছে, “আমি একা, আমি একা, আমি একা”।
তাহলে নাগরিক একাকীত্বের একমাত্র ওষুধ কি এই ছায়ার মায়া জগৎ, এই ‘সোশাল নেটওয়ার্ক’ ? ছায়া মানবের সাথে ছায়া মানবীর কথোপকথন, বন্ধুত্ব, প্রেম, অনুরাগ, বিরাগ? যেন এক অদৃশ্য তরঙ্গ বয়ে চলেছে মহাদেশ থেকে মহাদেশে, ছুঁয়ে চলেছে জীবন থেকে জীবনে, বন্ধুত্ব গড়ছে, দ্বীপের মত ভেসে বেড়ান মানুষগুলোর মাঝে গড়ে উঠছে সেতু। এদের মধ্যে এমন অনেকেই আছে যারা মনে করে যে এই ছায়া সরণির পথে পাওয়া বন্ধু রক্ত মাংসের মানুষের চেয়ে অনেক ভালো, দুঃখ দেবে না, ঠকাবে না, বন্ধুত্বের পরিবর্তে হয়তো প্রতিদানও চাইবে না। এমনই ভালো। ‘লগ ইন’ করে হাত বাড়ালেই বন্ধু আর ‘লগ আউট’ করে কম্প্যুটার অফ করলেই সব দায়বদ্ধতা শেষ।
কিন্তু এই জগত কি ওষুধ, নাকি অসুখ? যে একাকীত্ব কাটানোর জন্য এই একা মানুষগুলো দিনরাত এক করে ঐ মায়াজালে জড়িয়ে আছে, সেই একাকীত্ব কি কাটছে? নাকি বেড়ে চলেছে মানুষে মানুষে ব্যাবধান? ছায়া বন্ধুর টানে কি ভুলে যাচ্ছে না সে আসল বন্ধুকে? সে কি আরও একা হয়ে পড়ছে না?
ছাগলে কি না খায় …
মাঝে মাঝে ভাবি। আর অবাক হই, দেশটা কি ছাগলে ভরে গেল? না, না। একটু মন দিয়ে পড়ুন, আপনিও আমার কথার মানেটা ধরতে পারবেন।
আমার মনও সেদিন না বুঝে আঁতকে উঠেছিল, ‘সে কি? বেশ তো দু’পাওয়ালা মানুষগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে, টিভি, সিনেমা, ফেসবুক, টুইটার নিয়ে মেতে আছে, মাঝেমাঝে একটা আধটা বইও পড়ছে – এর মাঝে তুমি ছাগল দেখলে কোথায়ে? অনেক হয়েছে, এবার তোমার ওই খেয়ালে, খেয়ালে বিচরণ করাটা ছাড়ো, লেখায় মন দাও।’
এহেন মনকে বোঝাতে বসলাম। দেশ ভরেছে দু’পেয়ে ছাগলে। নাহলে টিভিতে দিন রাত শাশুড়ি-বউএর প্যানপ্যানানি, রদ্দি মার্কা লেখা গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজের কলম, শস্তা, চটুল গানের কলি, বস্তাপচা ফর্মুলায় ঢালা সিনেমা – এসবে বাজার ছেয়ে গেছে? আর এই দু’পেয়ে মানুষরূপী ছাগলের দল তাই তারিয়ে তারিয়ে চিবোচ্ছে?
মন বলল, ‘ইস, আস্তে! পাবলিককে ছাগল বললে? পাবলিক তো তোমার ব্লগও পড়ে। তারা রেগে যাবে!’
আমার মত হল, গানের কলি যদি হয় ‘ভাগ, ভাগ ডি কে বোস’; ‘বাপি, বাড়ি যা’ – পারিবারিক সংবাদ পত্রের, ম্যাগাজিনের ছত্রে ছত্রে যদি শুধু থাকে স্বল্পবাসিনি সুন্দরীদের ছবি – আর যদি ‘পাবলিক’ যদি তাই বিনা প্রতিবাদে, হাপুস-হুপুস শব্দে খায়ে, তাহলে আমার পাবলিককে ‘ছাগল’ বলাটা কি অন্যায়?
এই সেদিনকার কথা। একটা নতুন বই পড়তে শুরু করেছি। লেখক গত দুই দশক ধরে ভালো ভালো কিছু বই লিখে নামডাক করেছেন। ওনার লেখা পড়তে আমার বেশ ভালই লাগে। লেখনীতে একটা স্বচ্ছতা আছে আর ওই ইংরাজিতে যাকে বলে ‘ক্লিন ফীল’ – তাও আছে। নতুন বইএর প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করে সবে দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে ঢুকেছি, প্রেমিক-প্রেমিকা সবে চোখে চোখে প্রেমে পড়ছে – তৃতীয় প্যারাগ্রাফেই সেই চোখে চোখে প্রেম হঠাৎ একলাফে দেখি বিছানায় পৌঁছে গেল – বিনা বাক্য ব্যয়! বিনা কোনও কারণে! বইটা শেষ অবধি পড়েছিলাম, প্রিয় লেখকদের একজন বলে।
পরে জানলাম এক গুঢ় সত্য। ‘ব্যবসা করে তো খেতে হবে, আমাকেও, লেখককেও, পাবলিশারকেও, ফিল্মস্টারকেও, ফিল্ম ডাইরেক্টরকেও, নায়কেও, নায়িকাকেও – এমনকি খবরের কাগজগুলোকেও! তাই পাবলিক যা খেতে ভালবাসে আমরা তাই খাওয়াই। টি আর পি, বেস্ট সেলার লিস্ট, সুপারহিট কথাগুলো তো আর এমনি উঠে আসেনি, পাবলিক যা কিনছে, দেখছে, ভালবাসছে – সেটাই ট্রেন্ড আর তাতেই প্রফিট। পাবলিককে অবজ্ঞা করে কে কবে লাভ করেছে?’ – কার থেকে? তা নাই বা বললাম।
মন মাথা নেড়ে, চুক্ চুক্ করে বলল, ‘আর এই পাবলিকই একদিন সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল, বিমল, বুদ্ধদেব, হৃষীকেশে মজেছিল? আজ কি হল? খিদে বদলে গেল? কেন?’
আসলে মুশকিল কি জানেন? ব্যবসা। আর ব্যবসা দেবে কে? ওই গড্ডালিকা প্রবাহ। তাই ওই গড্ডালিকা প্রবাহ যাতে খিদে, পাবলিক যা ‘খাবে’, ব্যবসায়িরাও তাই বেচবে। তাই যেই ব্যবসায়ীদের বোধোদয় হয়েছে যে পাবলিকের ‘সেক্সের’ খিদেটাই সব থেকে অদম্য, ব্যাস্! গান, গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজ, ব্লগ – মায় ডিওডোরেন্ট, মোবাইল, ঘড়ি, সানগ্লাস পর্যন্ত – সব কিছু বেচতেই একই মশলা, সেক্স আর মন উস্কে দেওয়া সুড়সুড়ি।
নতুন যারা ব্যবসায় নেমেছে – ধরুন নতুন বই লিখেছে – সে জানে ‘বই বেচতে কয়েকটা সাহসী চ্যাপ্টার না লিখলে যে বই বিক্রি হয় না’ – পাবলিশার বলেছে। যে নতুন নায়ক বা নায়িকা, সেও তো লজ্জার তোয়ালে খসিয়ে না নাচলে তার ছবি দেখতে কেউ যাবে না – ডাইরেক্টার, প্রোডিউসার বলেছে। আর এদের দোষ দিয়ে লাভ কি? পাবলিক খাচ্ছে যে!
একটা সময় হয়তো ছিল যখন লেখক-লেখিকারা, সিনেমাওয়ালারা পাবলিকের মান উন্নত রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু, অনেক দিন হয়ে গেল এই ‘আঁতেল পোষণে’ আর কেউ পয়সা ঢালেনা। দলে, দলে ছাগল যখন স্বেচ্ছায় পয়সা ফেলে, সিটি মেরে যত্তসব রাবিশ গিলছে, তখন কতিপয় আঁতেলের গা জ্বলানো ন্যাকামি আর সূক্ষ্ম, চুলচেরা বিচার দিয়ে কি হবে?
বরং, প্রবীনবর, আপনি দূরে দাঁড়িয়ে ‘হায়, হা হতোস্মি’ না করে, আসুন এই নবীন সেক্সসেলারদের ভিড়ে ভিরে পরুন। তারপর? তারপর সামনে অপার সম্ভাবনা – কালজয়ী নাটক, নভেল, লিটফেস্ট, ফিল্মফেস্ট, বলিউড, হলিউড! তবে সব কিছুর আগে ছাগল ভোজন। ওইখানেতেই শুরু, কেননা, ছাগলে কি না খায়?
Picture courtesy ; bestclipartblog.com