RSS

Category Archives: বিভাগবিহীন

নীল ঠাকরুনের সবুজ দ্বীপে

আমি আমার এই বেআক্কেলে মনকে নিয়ে যে কি করি? যখন তখন যা খুশি ধাঁ করে বলে বসে।

আজ বলে কি না, “আজকাল নীল ঠাকরুনের সবুজ দ্বীপে আইন কানুন শিব ঠাকুরের একুশে আইনকেও হার মানাচ্ছে দেখি। চলতে গিয়ে কেউ যদি চায় এদিক, ওদিক, ডাইনে, বাঁয়ে, রানির কাছে খবর ছোটে, পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে”, মন এই বলে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার চারিপাশটা দেখে নিল চট করে। “বলা যায়না কে কোথায় ওঁত পেতে আছে! কেউ যদি যায় পিছলে প’ড়ে, পেয়াদা এসে পাকড়ে ধরে।”

“উফ, তুমি নিজের কাজে মন দাও না, মন আমার।” মৃদু ভর্ৎসনা করলাম বাচাল, বেআক্কেলে মনকে, “তা না সকাল সকাল সুকুমার রায়ের একুশে আইন নিয়ে পড়লে?”

“আহা!‘সেথায় রাত্রি ন’টার পরে নাচতে গেলে টিকিট লাগে – নাচলে পরে বিন টিকিটে, দমদমাদম লাগায়ে পিঠে’! কোটাল এসে নস্যি ঝাড়ে, একুশ দফা হাঁচিয়ে মারে।” আমাকে তোয়াক্কা না করে আমার দিকে একবার চোখ মটকে মন নিজের মনে ছড়া কাটতে লাগল, “নীল ঠাকরুনের সবুজ দেশে আইন কানুন সর্বনেশে …”

“সকাল থেকে কি সব নীল সবুজের মেলা বসেছে?” বেশ বিরক্ত লাগল আমার এসব হেঁয়ালি দেখে।

মন নিরুত্তাপ, মাথা নেড়ে বলল, “শোন আর বোঝো, না বুঝলে ফক্কা –

যে সব লোকে সত্যি বলে, তাদের ধরে খাঁচায় রেখে, কানের কাছে নানান সুরে, নামতা শোনায় একশো উড়ে – সামনে রেখে রানির বাণী – হিসেব কষায় একুশ খানি।

কোথাও যদি আগুন ধরে, শুধু ‘ষড়যন্ত্র’ নজরে পরে,

কারো যদি কপাল পোড়ে, আগেই চক্রান্তের তলব পরে,

খুঁচিয়ে পিঠে, গুঁজিয়ে ঘাড়, দিনকে বলায় রাতের আঁধার– এবার বুঝলে কিছু?”

“উফ, সব বুঝেছি। সব ঠিক হবে! এত তাড়া কিসের? সবে তো দশ মাস হল। এত  দিনের অনড়, অচলায়তনকে চালাতে তো সময় লাগে, না কি? দেয়ার হ্যাজ টু বি সাম মেথড ইন দ্য ম্যাডনেস। আমরা এত দূরে বসে সব কি দেখতে পাচ্ছি যে সব বুঝব?” মনের মাথায় হাত বোলাতে গেলাম ঠাণ্ডা কর’ব বলে।

“জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছ? দিবাস্বপ্ন ভাল, কিন্তু তা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে তাকে ইংরেজিতে ‘হ্যালুসিনেশান’ বলে, জানো তো সেটা?” ভড়কে উঠল মন।

আমি আর এত ভণিতা সহ্য করতে পারলাম না। “এবার দিনের আকাশে তারা গোণা বন্ধ ক’র দেখি। রাখো তোমার ছড়া কাটা!”

আমার কথা যেন কানের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেল, এমন ভাব করে, মন ভাবুক সুরে বলে উঠল “আর ওই নীল আকাশের আকাশী রঙ যদি মাটিতে নামে? কি নাম দেবে তাকে? নিলঠাকরুনের নীলের প্রলেপ?”

আবার সেই বাঁকা মনের আঁকাবাঁকা কথা।

রাণী ‘পরিবর্তন আনব’ ব’লে, সবার মন দিল ভ’রে,

আকাশ ছোঁয়া আশার প্রাসাদ, সেথায় একুশ প্রমিস ঘর করে;

পরিবর্তন এলোও শেষে, এক নীল শৃগালের বেশে।

বাড়ির দেওয়াল, স্কুলের গেটে,

সেতু, রেলিং, মায় ময়দানের অশ্বত্থ, বটে;

ঠাকরুণের এই নীল প্রলেপে, আকাশ মাটি গেল মিশে।

কি আর বলে বোঝাই তোমায় মন? মনে মনে আমিও জানি তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্যি। দশ মাস আগে দেখেছিলাম লাল আকাশটার রক্তিম আভা আস্তে আস্তে কেটে গিয়ে ফুটে উঠছে নীল রূপ। ছত্রিশ বছর যে ভারি জগদ্দল পাথরটা বুকের উপর চেপে বসেছিল, তার তলা থেকে রেহাই পেয়ে জরাগ্রস্ত শহরটা খোলা আকাশের নিচে শ্বাস নিতে শুরু করেছিল সবে। সবার মনে আকাশচুম্বী প্রত্যাশা ছিল সেদিন। আমিও আমার পরবাসী সংসারে যেন এক নতুন আশা নিয়ে ফিরেছিলাম। হয়তো মনের কোণে ফেরার টান জন্মেছিল সেদিন।

আজ তার বদলে দূরে বসে আমার প্রিয় শহরটাকে নীলবর্ণ শৃগালে রূপান্তরিত হতে দেখছি। নানা চাল বানচাল হয়ে যাচ্ছে, অনেক কিছু বেহিসাবি হয়ে পড়ছে আরও। মাঝেমাঝে আমিও প্রশ্ন করি, ‘ব্যাস, এই সেই ‘পরিবর্তন’?’ তারপর আবার নিজেকে সংযত রেখে, নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে, দূরে বসে অপেক্ষা করি দিন বদলের। দশ মাসের গর্ভাবস্থার শেষে সবে প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে বুঝি, দেখিই না দানব জন্মায় না দেবশিশু। তাই বলি কি মন, তুমিও দাঁড়ে বসে তোতাপাখির মত ছড়া না কেটে আর একটু ধৈর্য ধরো।

……………………………………………………………

 

তুই আর তোর সাদা কালো ছবিগুলো

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

“বৃষ্টি ভেজা, সোঁদা মাটির গন্ধ। ভিজে ভিজে আঁধার ঘেরা আকাশ। এক পশলা বৃষ্টিতে হালকা ভিজে দুপুর। ভেজা মন। ভেজা চোখ। ভেজা ভেজা এলোমেলো, সাদা কালো ঝাপসা ক’টা স্মৃতি। তুই আর আমি, একটাই ছাতা, তোর টোল পড়া হাসি, বৃষ্টি ভেজা চুল। আর আমি? এক বছর ধরে শুধু তোর স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে ভিজে চলেছি, রোদঝড়বৃষ্টিতে খুঁজে চলেছি তোকে।”

জানিস, আজ সকালে একটা ভিডিও পেলাম হোয়াটস্যাপে।
সেই ছোট্ট ছেলেটাকে মনে আছে তোর, যার অন্নপ্রাশন আর আমার আইবুড়োভাত দিদা একই দিনে দিয়েছিল? মনে আছে? আমি বোধহয় একটা লাল শাড়ি পড়েছিলাম সেদিন, গলায়ে ছিল দিদার বিয়ের সোনার নেকলেসটা, আমার এলো খোঁপায়ে জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে দিয়েছিলিস তুই। আর সেই ছেলেটা, ছোট্ট ধুতি পড়া গোল গোল পায়ে রুপোর বালা পড়েছিল। সেই ছোট্ট ছেলেটা, যে তোর বাসি বিয়ের দিন রিমি আর পিপলুকে সাথে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের গিটার বাজিয়ে গলা ফাটিয়ে গান গাইছিল? সেই ছেলেটা, তোর আর আমার মামাতো ভাই তাতাই, আজ আবার গিটার বাজিয়ে, গলা ছেড়ে ইংরাজি পপ গান গাইল, আমার চালাক ফোনটার স্ক্রিনে ইউটিউবে দেখলাম। তারপরই মনে হল তোকে ফোন করি, ওই ভিডিওটা নিয়ে গল্প করি, সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে, কলেজ ফেস্টে এরকম করে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে কতগুলো মেয়েকে কাত করবে – তা নিয়ে হাসাহাসি করি, বলি তোকে যে যখন এই ছেলেটা নিজের মনে গুটিয়ে গিয়েছিল, তখন তুই ভাগ্যিস ওর দিকে তোর দুটো হাত বাড়িয়ে রেখেছিলি, ভাগ্যিস তুই ছিলি ওর পাশে ওর কথা শোনার জন্য। ভাগ্যিস তুই ছিলি।

মনে হল আরও গল্প করি। অনেক গল্প করি। কতদিন তোর সাথে প্রাণ মন ভরে আড্ডা মারিনি, আজ ফোন করি। আজ প্রায় এক বছর ধরে তোর সাথে তো শুধু মনে মনেই কথা হয়। ফোন করা হয় না। মেসেজ পাঠানো হয় না। হোয়াটস্যাপ করি না। সেই আগেকার মত তুই ফেসবুকে আমার ছবি লাইক করিস না, কমেন্টও করিস না। তোর সাথে শুধু মনে মনে এক তরফা কথা বলে যাই আমি, সব খবর দিই, ভালো, মন্দ, অপ্রাসঙ্গিক, আমার যত নালিশ, যত ঝগড়া, অভিমানের গল্প, না বোঝা নানা সমস্যার জট যার গেঁড়ো একমাত্র তুই আলগা করে আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারিস। কত দিন প্রাণ ভরে পরনিন্দা পরচর্চা থুড়ি পি-এন-পি-সি করিনি বল তো তোর সাথে? তোর সাথে ছাড়া আর কার সাথে করব? কে চেনে এতো লোককে, যাদের শুধু তুই আর আমি চিনি চিরকাল ধরে? কে চেনে মুখোসের পিছনের আসল মানুষগুলোকে, যেভাবে তুই আর আমি চিনি? কে জানে আমাকে এতো কাছ থেকে যেমন করে তুই আমাকে চিনিস? জানিস তোর বলা কথাগুলো থেকে আমি নিজেকে কতটা চিনতে শিখেছি? তুই কি জানিস তোকে বলা কত কথা আমি আর কাউকে বলি না? আমি এও জানি যে তুই আমাকে যে কথাগুলো বলিস তা তুইও আর কাউকে বলিস না। তুই কি জানিস তুই আমার সেতু? কেন? একটু পরে বলব। এখন শুধু বলব, ভাগ্যিস তুই ছিলি।

 

মনে আছে, বম্বের সেই রাতগুলোর কথা? মাঝরাত পেরিয়ে যেত, কাপের পর কাপ ধূমেল চা শেষ হয়ে যেত কিন্তু আড্ডা ফুরতো না। মনে আছে মেয়েবেলার কলকাতার বৃষ্টি ভেজা দুপুরগুলোর কথা, একটা ছাতার নীচে ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা? তুই হি হি করে হেসে বলতিস, “দ্যাখ দিদি, আমরা কেমন খাপে খাপে বসে যাই! দুটো ছাতার কি দরকার?”। সন্ধ্যেবেলায় ছাতে বসে থিম্পুর আনা সিগারেটে সুখটান মারা তিনজনে? মনে আছে তোকে শুতে পাঠিয়ে তোর জন্যে রাত জেগেছি, কত ছবি এঁকে দিয়েছি, স্কুলের কাজ করে দিয়েছি আমি? প্রচণ্ড শীতের রাতে ঘুম ভেঙ্গে তোর ঠাণ্ডা গায়ে আবার টেনে দিয়েছি তোর ঠেলে ফেলা লেপ? কলেজ স্কোয়ারে, টাউন স্কুলে, আমার কলেজের পাড়ায়, গড়িয়াহাটে, নিউ মার্কেটে – ফুচকাওয়ালা দেখলেই হল, উপুড় হয়ে ফুচকা খাওয়া? স্কুল থেকে নিজে না খেয়ে তোর জন্য বাঁচিয়ে আনা লজেন্সগুলো? তোর গানের ক্লাস আর হারমোনিয়াম আর আমার মোটা মোটা গল্পের বই। কিন্তু গল্পের বই দেখলে পালাতিস তুই। তবে তুই চিরকালই কি সুন্দর গান গাইতিস, আর আমি? সুরতালজ্ঞানহীন। তুই উত্তম কুমারের ফ্যান আর আমি সৌমিত্রর। পাড়ার পার্কের ধারে বুড়োদাদুর থেকে কেনা আলু কাবলির শালপাতা চেটে চেটে খাওয়া। বিনা কারণে খি খি হেসে গড়াগড়ি যাওয়া। আর আমার ওপর রেগে গেলে, আমার পিঠে বসে আমাকে কাতুকুতু দেওয়া। শীতের দিনে সারাদিন ছাতে রোদে পড়ে থাকা আর গরম পড়লে কাকভোরে সাঁতার শিখতে যাওয়া।

তোকে আমিও পাগল করে দিতাম কাতুকুতু দিয়ে আর আমার প্রিয় গল্পের বইগুলো পড়তে বলে। তুই আমাকে পাগলা করে দিতিস তোর জ্ঞানের বহর দিয়ে। না, মিথ্যা বিদ্যা জাহির করে নয়, সে মেয়ে তুই নয়। তুই চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া! প্রশ্ন করলেই উত্তর হাজির। আমি তোর অধ্যবসায়ের কাছে আজও নতি স্বীকার করি। তবে সেটা যে তোর দুর্বলতাও ছিল তা মানবি? মাধ্যমিকের তোর প্রিয়তম সাবজেক্ট হিস্ট্রি পরীক্ষার কথা মনে আছে? মাধ্যমিকের ঠিক এক মাস আগে কাঁদতে কাঁদতে তুই শয্যা নিলি, কেননা তোর নাকি হিস্ট্রি পড়া একদম ভাল করে হয়নি, সাজেশান অনুযায়ী প্রশ্ন উত্তর তৈরি হয়নি, তুই নাকি ফেল করবি হিস্ট্রিতে, এমন কি কোনও প্রশ্ন উত্তরই নাকি তোর লেখা নেই। আমি কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম, তোকে আর হিস্ট্রিকে উদ্ধার করতে। সারা সকাল তোর আর আমার বইয়ের আলমারিগুলো ঘেঁটে শেষে বেরোল গোটা আষ্টেক খাতা, প্রথম থেকে শেষ অবধি ইতিহাসের নানা যুগের উপর প্রশ্ন উত্তরে ভরা। আর একটি বিশেষ প্রশ্ন “ঔরংজেবকে কি মুঘল সালতানাতের পতনের মূল কারণ বলা যায়? উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা দাও।” মনে আছে এই কোশ্চেনটির কয়বার আনসার লিখেছিলেন আপনি, দেবী সরস্বতী? সাতবার!

আমার কলেজের দিনগুলো, আমার স্বল্পস্থায়ী ভালোবাসারা, আমার পাওয়া প্রেমপত্রের পাহাড়, তাদের ডাকে সাড়া না দেওয়া, আর যারা আমাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস দিয়ে যেত – তারা? মনে আছে সব তোর, বল? তারপর এলো তোর জীবনে ঝড় তোলা দিনগুলো, তোর প্রথম প্রেম, বাপেরবাড়িতে থাকতে এসে লুকিয়ে পড়া তোর লেখা ডাইরি, ডাইরির পাতায় পাতায় তোর হাতে লেখা নতুন একটা নাম, তোর ইউনিভার্সিটির উত্তাল সন্ধ্যাগুলো। তখন তোর আর আমার মাঝে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব – কিন্তু তোর জীবনে আমার খবরদারি করা আটকাতে পেরেছে কেউ কোনোদিন? তাই তো সেদিন, যেদিন সবকিছু ফেলে চলে গেছিলাম তোর কাছে, তুই আমাকে “আমার সোনা মা, আমার সোনা মা” বলে বুকে টেনে নিয়েছিলি।

আসলে তোকে খুব ভালবাসি। যেদিন প্রথম তোকে কোলে নিলাম, কেউ যেন আমাকে কানেকানে বলে দিল “আজ থেকে তোর কাছে আমার অতি প্রিয় রত্নটিকে গচ্ছিত রাখলাম, দেখিস হারিয়ে ফেলিস না যেন, সামলে রাখিস।” ব্যাস, সেই মুহূর্ত থেকে আমি তোর ওপর দিদিগিরি ফলানোর লাইসেন্স পেয়ে গেলাম।

এখনো মনে পড়লে হাসি পায়, তোর এক অতি প্রিয় কলেজের বন্ধুকে হাত করার জন্য ধরে নিয়ে গেছিলাম কফিহাউসে, প্রচুর চপ কাটলেট আর দু কাপ কফির শেষে সে বলে দিল কার সাথে প্রেম করছিস তুই। আমি বললাম “জানি”। আমার দরকার ছিল অন্য। আর্জি করলাম আমি তার কাছে, যাতে তোর খুব কাছের বন্ধু হিসেবে তোকে বোঝায়ে কি বিরাট ভুল করছিস তুই, যাতে বোঝায়ে সেই ভুল শুধরে নিতে। বিশ্বাস কর, যদি সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারি আবার, আমি আবার সেই এক ভাবেই ঘুষ দিয়ে ভাঙ্গাবো তোর ভুল। বার বার প্রতিবার। যতই রাগ, অভিমান, ঝগড়া – যাই করিস, আমার ভারি বয়েই গেছে।

কেন তুই আমার সেতু? এখনো বুঝলি না? কলকাতা ছেড়ে ভবঘুরে জীবন আমার গত উনিশ বছর, তার মধ্যে আঠারোটা বছর সবার আর আমার মাঝে তুই আমার সেতু। আমি তোর চোখ দিয়ে দেখেছি আমার ফেলে আসা শহরটাকে, দেখেছি তাকে বদলাতে, দেখেছি বয়স বাড়তে সবার, চিনেছি তাদের তোর মাধ্যমে, তোর চোখ দিয়ে দেখেছি তাদের পাল্টে যাওয়া। তোর সূত্রে বাঁধা পড়ে থেকেছি আলগা হয়ে আসা অনেকগুলো সম্পর্কের সাথে, তোর সূত্রে পাতিয়েছি কত নতুন বন্ধুত্ব। আর তুই আমার হয়ে বজায় রেখেছিস পুরনো কিছু সম্পর্কের চাহিদাগুলো, আমার হয়ে পালন করে গেছিস কত দায়িত্ব, আমি দূরে বসে নিশ্চিন্তে, নির্দ্বিধায় ছেড়ে রেখেছি আমার দায়ভার তোর ওপর। ভাগ্যিস তুই ছিলি।

মনে পড়ল সুইডেনের একটা রোদ ঝলমলে দিন থেকে তোর ফোন। কি খুশি খুশি শোনাচ্ছিল তোর গলাটা। তুই বললি “দিদি, আমার সামনে, রাস্তার কোণায় জানিস এক দঙ্গল হলদে রঙের ফুল ফুটে আছে, দেখেই তোর কথা মনে পড়ল! আমি তোর মত হতে চাই, তুই যেমন খুব ছোট্ট ছোট্ট জিনিসে খুশি হয়ে যাস, আমিও সেইরকম হতে চাই!”

সেদিন আমি কাঁদিনি জানিস। আমি মনে মনে নিজেকে বলেছিলাম আমি তোর মত হতে চাই, একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, যার অনাবিল হাসি ভাসিয়ে দিতে পারে সব দুঃখ, যে সব্বাইকে নিঃস্বার্থের মত আপন করে নিতে পারে, যে আমার সব থেকে আপন। আমার বোন।

ঠিক এক বছর আগে, সেদিন সুইডেন থেকে ফেরার পথে, কোপেনহাগেন এয়ারপোর্টে বাবা দাঁড়িয়ে ছিল তোর দেওয়া সবুজ স্কটিশ মাফলারটা গলায়, বিদেশী ঢঙে ফাঁস দিয়ে জড়িয়ে। বড্ড হ্যান্ডসাম লাগছিল দেখতে। এক লহমায় সব ভুলে গেলাম আমি, মুচকি হেসে ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলাম, তোকে হোয়াটস্যাপে পাঠাব “বাপীকে কি হ্যান্ডসাম লাগছে দ্যাখ!” বলে। না, তারপর ছবিও তোলা হয়নি, মেসেজও পাঠানো হয়নি, বাস্তবটা হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল যে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি সারা জীবনের মত।

ছোট্ট থেকে তোর আর আমার দুজনের চোখে ছিল একটাই স্বপ্ন – বুড়ো বয়েসে, পাকা চুল আর ফোকলা দাঁত নিয়ে সেই মেয়েবেলার দিনগুলোর মতন একটা ছাতার তলায়ে ভিজব, কলকাতার বৃষ্টিতে। এক বছর ধরে তুই বৃষ্টি হয়ে টুপটাপ ঝরে চলেছিস, আমার স্বপ্নটা অপূর্ণ রয়ে গেল।

 

 

সেলফি তুমি কার?

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

এক বান্ধবীর সাথে প্রায় বছরখানেক বাদে সেদিন হঠাৎ দেখা এক জলসায়ে। এতদিন পরে দেখা, তবুও সে কোনওরকমের গৌরচন্দ্রিকা না করেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে উঠল, ‘তোমার ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারটা দেখলাম! ঐ যে, যেটায় লিখেছ “সেলফি অ্যাডিক্ট স্ট্রাইকস আগেইন!’ – ছবিটা যা সুন্দর উঠেছে না! মনেই হচ্ছে না যে ওটা সেলফি। আমি তো এবার তোমার থেকে সেলফি তোলার ক্লাস নেব ভাবছি!”

এরকম আলাপচারিতায় কারো কখনো আপত্তি হয় আবার? আমি বিগলিত হাসি হেসে বললাম “আরে দূর, এতে আবার ক্লাস নেওয়ার কি আছে? ক্যামেরাটা ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে মাথার উপর থেকে তাক করবে, বা সোজাসুজি হাসিমুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলবে ‘আই লাভ ইউ’ অ্যান্ড ক্লিক! ব্যাস, সেলফি ডান! আপলোড টু ফেসবুক!”
মন বলল “ঢং!”

আমি মনে মনে মনকে সুধালাম, ‘কেন? এতে ঢঙের কি হল? কি করলে কি হয়, সব খবর কি তুমি রাখ? কোনোদিন নিজের সেলফি তুলেছ?’

“নারসিসাসের নাম শুনেছ? গ্রিক মাইথলজি পড়েছিলে? ব্যাটা জলে নিজের ছায়া দেখে নিজের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল, তা জানো নিশ্চয়ই?” আমার মনের এই এক স্বভাব, যত্র তত্র যাঁহা তাঁহা ঝাঁপি খুলে বসে জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করে। আমি আপাতত মনের গলা টিপে বন্ধু, জলসা, গানবাজনা, নিজের প্রশংসা শোনার দিকে মন দিলাম। মন মনে মনে ‘নারসিসাস, নারসিসাস, নারসিসাস, নারসিসাস …’ বলে আমাকে গাল পাড়তে থাকল।

রাতে বাড়ি ফিরে মনের কানে আলতো মোচড় মেরে বললাম “তুমি ভারি হিংসুটে! আমার সেলফিকে সুন্দর বলা মানে কি তোমাকে সুন্দর বলা নয়? তাই বলে তুমি আমাকে যা পারো কটু কথা শোনাবে? হিংসুটে, হিংসুটে, হিংসুটে!”
মন উদাস ভাবে মাথা নাড়ল। “যার তরে করি চুরি, সেই কয় চোর। আচ্ছা, বল দেখি, তুমি সেলফি তোল কেন?”
বাইরে এখন নিস্তব্ধ, অন্ধকারে থমকে থাকা রাত, অনেক নীচে জেগে আছে শুধু পাড়ার সারমেয়র দল। কোথায়ে এখন আরাম করে ঘুমোব, না এখন আমাকে মনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমার সেলফি তোলা নিয়ে?
“রাখো তোমার গোয়েন্দাগিরি, এখন অনেক রাত, নিজে ঘুমোও আর আমাকেও ঘুমোতে দাও। কাল সকালে তোমার উত্তর দেবখন, কেমন?”

মন একটু গাল ফুলিয়ে চুপ করল, কিন্তু আমার মাথায়ে হঠাৎ প্রশ্নটা কেমন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, নট নড়নচড়ন কিচ্ছু।
আমি তো সেলফি নিজের জন্যই তুলি, না?
মন বলল, “না, একদম না।”
তাহলে?
“যাতে ফেসবুকে, টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপের ‘ফ্রেন্ড লিস্টে’ তোমার যত খেঁদি, বুঁচি, টেঁপির মা আছে, এবং আনাচে কানাচে তোমার যত সব প্রাক্তন প্রেমিকরা আছে, তাদের সব্বার গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য।”

সে আবার কি কথা? আমি মানছি, আমি আজকাল একটু বেশিই ছবি তুলি নিজের। সেজেগুজে কোথাও যাবার সময়ে মনে হয় না বুঝি একবার দেখে নিই সাজটা কেমন হল? আয়নায় তো দেখলামই, সেই সাজের একটা ছবি তুলে রাখলে কি এমন ক্ষতি হয় কার? অবসরে বেশ ফোনের অ্যালবাম খুলে দেখতে পারি আমার নানা সাজগোজ, আমার নানা রূপ, নানা মুডের ছবি। আর তো বেশি দিন এই বয়স, এই চেহারা থাকবে না, সময়ের নিয়মে বয়স ঢলবে, চেহারা, মুখের আদল বদলাবে, পাল্টে যাবে পৃথিবীকে, নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও হয়তো, বদলে যাবে সাজের ধারা, বাড়বে নাহলে কমবে সাজের বহর। তাই আমি হয়তো ধরে রাখতে চাই নিজেকে এই ছবিগুলোর ফ্রেমে, হয়তো বেঁধে রাখতে চাই এই সময়টাকে, যাতে জীবনের সায়াহ্নে বসে একপাক ঘুরে যেতে পারি এই সময়ে।

Taking A Selfie, Trafalgar Square, London, UK

মাঝে মাঝে যখন আবার তোমার মনের মত সাজি, তখন মনে হয় তুমি একবার চোখ তুলে চেয়ে বলবে ‘বাহ!’। কখনও কখনো তোমার ফোনের আর ল্যাপটপের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি পড়ে যাই হিসেবের বাইরে, অতীতে সেই সব সময়গুলো হয়ে দাঁড়াত দাম্পত্য কলহের কারণ – এখন সে সব সমস্যার সমাধান একটাই – সেলফি তুলে রাখি, এখন সময় না থাকলে পরে তোমার ফুরসতে তুমি যখন ফেসবুক বা টুইটার দেখবে, তখন হয়তো আমার ছবিটা দেখে বলবে ‘বাহ!’ – মুগ্ধ হবে আগেকার মত, হোক না তা ভারচুয়ালি।

ও, আরও একটা কারণ আছে। সব্বাইকে দেখি কেমন নানা পোজে, আঁকাবাঁকা নদীর মত এদিকে ওদিকে কাত হয়ে ছবি তোলায়ে একে ওকে তাকে দিয়ে। দিব্যি স্মার্টলি স্মার্ট ফোনটা কারো হাতে সোজা ধরিয়ে দিয়ে শাড়ি গয়না গুছিয়ে, চুলটা এলো করে, দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় কাৎ করে ক্যামেরার সামনে। আমি না ছিঁচকাঁদুনের মত যাকে তাকে ধরে বলতে পারি না, “আমার একটা ছবি তুলে দাও না, প্লীজ!” আমি লুকিয়ে চুরিয়ে নিরালায় বসে নিজেই নিজের ছবি তুলি। বেশ একটা স্বাধীনতা আছে নিজের হাতে নিজের ছবি তোলার – কেমন নির্দ্বিধায় নানা মুখভঙ্গি করে, হেসে, দাঁড়িয়ে, বসে, যে কোন ভাবে ইচ্ছে, যতগুলো ইচ্ছে, কেউ বিরক্ত হবে না বা বুড়ো বয়সের ঢং বলে ব্যাঙ্গও করবে না – দরকার শুধু একটু নিজেকে ভালোবাসা।

মন আড়মোড়া ভেঙ্গে, ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “স্বীকার করলে তাহলে গভীর আত্মপ্রেম অর্থাৎ নারসিসিজমই এসব বেহেড কাজকর্মের মূল কারণ? নিজেকে ভালোবাসলে, সেই ভালোবাসার প্রতিফলন কি মাথার উপর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকেই বোঝা যায়? নাকি মুখটা বেঁকিয়ে, কি বলে বেশ, হ্যাঁ ‘পাউট’ করে ছবি তুললেই বেশ পৃথিবী বোঝে তুমি কত নিজেকে ভালোবাসো? ছোট ছোট মেয়েগুলোকে দেখেছ, তেরো থেকে তেত্রিশ? তোমাদের মত বুড়িদের থেকে তারা আরও দুই পা এগিয়ে! ঘুম থেকে চোখ খুলে সেলফি, চান করা ভেজা চুলে সেলফি, হাতে নতুন রঙের নেলপালিশ পড়ে সেলফি। বন্ধু পাতালে? সেলফি। প্রেমে পড়লে? সেলফি। নতুন জামা কিনতে গিয়ে? সেলফি। মলের জামাকাপড়ের ট্রায়াল রুমে নতুন নতুন প্রতিটা জামা পড়ে পড়ে দেখার সময়? সেলফি। গান শুনতে, সাবওয়ে খেতে, স্কুলে/কলেজে/অফিসে যেতে আসতে, রাস্তায়ে হাঁটতে হাঁটতে, বিয়েবাড়িতে, পার্টিতে, নাচতে নাচতে, আর প্রাণ যা চায় সব কিছুর – চাই একাধিক সেলফি। আজকাল দেখ কচি কি দামড়া, ছেলেগুলোও গাছের তলায়, বাইকে বসে, মেয়ের কাঁধে হাত রেখে, বিয়ারের বোতলে ঠোঁট ছুঁইয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, চোখ মটকে, রকস্টারদের মত নানা পোজ মেরে সেলফি তোলে!”
মনের ঘুম দেখলাম উড়ে গেছে।

“কিন্তু, আমি দিনে দশ গণ্ডা ছবিও তুলি না নিজের, না আমি অন্যদের মত ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফেসবুকে সেলফি আপলোড করি। আর ওই কচি কাঁচাদের মত সবসময়ে সব কিছুর মধ্যে নিজেকে ওরকম হারিয়ে ফেলি না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে গত কয়েক বছরে সেলফি ফিভারে সব্বাই কাবু, সেলফি অ্যাডিকশান এখন সব থেকে তুঙ্গে। মনে আছে গতবছর জুলাই মাসে ইটালিতে কি কাণ্ড দেখে এলাম? এই লম্বা লম্বা সেলফি স্টিক নিয়ে ঘুরছে সব টুরিস্টরা, কোথাও দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কিছু দেখার উপায় নেই, চোখের সামনে শুধু সেলফি স্টিকের ভিড় – সে মাইকেলএঞ্জেলোর মাস্টারপিস ডেভিডের স্ট্যাচুই হোক বা আড়াই হাজার বছরের পুরানো কোলোসিয়াম, মিলানের ফ্যাশান কোয়াডিল্যাটারাল অথবা ভেনিসের রিয়াল্টো ব্রিজ, রোমের টিবের নদীর পাড়ে মেলায়ে, ফ্লোরেন্সে আরনোর পাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে, পিজার হেলানো টাওয়ারে, কাপ্রি দ্বীপের নীল জলে – এমন কি ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকার প্রতিটা কোণায় কোণায় – কেউ কিছু আর চোখ দিয়ে দেখে না, মনে ধরে রাখতে চায় না, সব জায়গায় খালি ফোনের ক্যামেরার সামনে নিজের মাথা গুঁজে সেলফি তুলে বন্দি করে রাখতে চায়। এমনকি মন্ত্রীরা খরা পরিদর্শনে গিয়ে আজকাল সেলফি তোলে। যাচ্ছেতাই!”

“এগজ্যাক্টলি! যাচ্ছেতাই-ই বটে!”

ঘুম কোন আইন মানে না, হঠাৎ হানা দেয় যাকে তাকে যেখানে সেখানে। এই রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিস্কাশানের মাঝখানে আমি হঠাৎ দেখলাম আমি ঢুলে পরেছি আর মনও মুখ গোমড়া করে দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। এই সুযোগ কি কেউ আর ছাড়ে, আমিও পাশ ফিরে তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতল নিস্তব্ধতায়। মনকে ফিসফিস করে বলে রাখলাম “এ গপ্পের অনেক লম্বা লেজ, এক রাতে ফুরোবে না, এখন ঘুমোও – বাকি কথা কাল হবে।”

কিন্তু কাল ‘আসি, আসি’ করেও আর এলো না। উল্টে আমি মাসখানেকের জন্য কাত হয়ে পড়লাম নানা ছোটখাটো রোগের ধাক্কায়। এমন কাত হলাম যে মাথা তোলার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে গেল দিনকতক। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বিশ্বভ্রমণ, পাড়াবেড়ানো, পরনিন্দা পরচর্চা, প্রেম, অনুরাগ, বিরাগ, ঝগড়া, ভাব ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ন সব কাজকর্ম ফোনে, মোবাইল ফোনে, অনলাইন ইথারের তরঙ্গে হল সে কদিন।
এরই মাঝে ফেসবুক খুলে একদিন কি যেন দেখছি, হঠাৎ কি মনে করে খুললাম আমার সেই কুখ্যাত সেলফি প্রোফাইল পিকচার।

বেশ ঝলমলে একটা দিনে খোলা জানালার পাশে এলোচুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম বোধহয়, রোদের ঝলক চুলে, চোখে, টিপে – কি জানি নিজের কোন খেয়ালে নিজের দিকে তাকিয়েই হাসছি, হারিয়ে আছি নিজের মধ্যে আমি, নিজের খেয়ালে – যেন সেই মুহূর্তটা শুধু আমার, তাতে আর কারো প্রবেশ নিষেধ। নিজের সাথে এই অন্তরঙ্গতা দেখে মনটা বেশ ভরে গেলো।

না, কোনও নার্সিসিজম চোখে পড়ল না তো। না কোনওরকমের আগলছাড়া, পাগলপারা আত্মপ্রেম। আমার সেলফি, আমারই মত, আমার নিজের সাথে কাটানো একটা সুন্দর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি মাত্র, কোন দুর্বল মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি নয়।

“থাক, এই ছবিটা পাল্টিও না তাহলে।” বলে মন ফুরর করে উড়ে গিয়ে দাঁড়ে বসে নিজকাজে মন দিল।

 

যতসব উদ্বাস্তুর দল!

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

ক’দিন ধরেই দেখছি জানালার পাশে রাখা পাতা বাহারটার টব থেকে লাইন করে এক দল কালো পিঁপড়ে পাশেই রাখা বইয়ের আলমারির পিছনে সেঁধোচ্ছে। প্রতিদিন, নিয়ম করে। আজও সকালে
দেখলাম তাদের নিয়মের কোন বেনিয়ম হয়নি। টব থেকে আলমারির পিছনে দেওয়ালের ফাটল অব্দি পিঁপড়ের সার হেঁটে চলেছে।

“উদ্বাস্তু, উদ্বাস্তু!” মন বলল, “গরমের ছুটি কাটাতে যাবার সময় গাছের টবগুলোকে নীচের উঠোনে হাওয়া খেতে পাঠিয়েছিলে, সেই উঠোনের টালির ফাটল থেকে পিঁপড়েগুলো এসে বাসা বেঁধেছিল
তোমার টবে। এখন আরও পাকাপাকি সংসার পাততে ঢুকছে তোমার দেওয়ালের ফাটলে। যতসব উদ্বাস্তুর দল!”
সামনে চায়ের কাপের তলায়ে চাপা খবরের কাগজটা আমার মন পাওয়ার আশায় ফরফর করে চলেছে। আমি তাকে সাময়িক ভাবে এড়িয়ে, আমার বুদ্ধিমতী আই ফোনটিকে হাতে নিলাম। এক সপ্তাহ
ধরে নানা কাজের চাপে অনেক গুলো ভালো ভালো প্রবন্ধ এদিক ওদিক থেকে জমা হয়েছে সাফারির বুকমার্কে, ‘সবার আগে ওগুলো আজ পড়তেই হবে’ মনে করে বসেছি। তাই সেদিকে মন দিলাম।
কিন্তু মাথায়ে আমার ‘উদ্বাস্তু’ কথাটা থমকে থেকে গেলো।

মনে পড়ল সারা বিশ্বে ঝড় তোলা সেই ছবিটা – শান্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ে লাল শার্ট পড়া ছোট্ট খোকার নিঃস্পন্দ শরীর। ছবিটা এক নজর দেখলে মনে হয় দুষ্টুমি করে জলের ধারে গা গড়িয়ে দিয়েছে
খোকা, খেলছে হাল্কা ছলকানো ঢেউয়ের সাথে, এখনি উঠে দৌড়ে যাবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে মায়ের কোলে, খিলখিলিয়ে হেসে ভিজিয়ে দেবে মায়ের মন, মুখ, শরীর। আমি কতদিন এই ছবিটাই বিশ্বাস
করতে চেয়েছি, মানতে চাইনি মায়ের শিথিল হয়ে আসা হাতের আগল থেকে আয়লানের ছোট্ট শরীরটা তলিয়ে গেছিল ঝড়ে উত্তাল সমুদ্রে, ঢেউয়ের ধাক্কায় আছড়ে পড়েছিল তুরস্কের সাগরতীরে।
কেন? কেননা তার মা বা বাবা চায়নি সিরিয়ার যুদ্ধের বোমার শিকার হতে, চায়নি আয়লান আর তার ভাইয়েরা একটু বড় হয়েই হাতে তুলে নিক বড় বড় বন্দুক, প্রাণ দিক দেশের গৃহযুদ্ধে। তারা
চেয়েছিল সময় থাকতে গিয়ে উঠতে ইউরোপের কোনও দেশে, তারপর পাড়ি দিতে সুদূর কানাডায়, যাতে তাদের জীবনে ফিরে আসে একটুখানি শান্তি, খানিকটা নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব, নিশ্চল স্থায়িত্ব।

migrant-child-dead-beach-turkey.jpg

ওই পিঁপড়ের সারির মত লাখে লাখে মানুষ সব কিছু ছেড়ে, শেকড় উপড়ে ভেসে পড়ছে অজানা সাগরে রোজ, শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্য প্রাচ্য থেকেই নয়, আফ্রিকার নানা গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে, দক্ষিণ
এশীয় দেশগুলোও ছেড়ে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকেও। কেউ পালাচ্ছে যুদ্ধের থেকে, কেউ পালাচ্ছে না খেতে পেয়ে, কেউ পালাচ্ছে খরা থেকে, তো কেউ বন্যার থেকে। সব্বাই পাড়ি দিচ্ছে
আপাতশান্ত, আপাতস্বচ্ছল দেশগুলোর দিকে। সবার একটাই লক্ষ্য, যাতে প্রাণ বাঁচে, যাতে তারা অন্য কোথাও গড়ে তুলতে পারে নিরাপদ জীবন, নিজের আর আপনজনেদের জন্য।

যে কোনও ছুটির বাহানায় যখনই নিজের গণ্ডীর বাইরে বেড়িয়ে দেশবিদেশের নানা শহরে যাই, চোখে পড়ে কোনও গলির বাঁকে, সদর রাস্তায়, বাজারের ভিড়ে মাথা নিচু করে ভিক্ষা চাইছে কেউ,
সামনে কাঁপা হাতে বাঁকাচোরা অক্ষরে লেখা আবেদন – বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বক্তব্য “আমি অমুক দেশ থেকে আসা শরণার্থি – আমাকে সাহায্য কর”। কেউ ইরাকের, কেউ প্যালেস্টাইনের, কেউ বা
এসেছে কাশ্মীর, আফগানিস্তান, মায়ানমার, উগান্ডা, নাইজিরিয়া থেকে। আবার কখনও চোখে পড়ে মন্দির, গির্জা, মিউজিয়াম, রাজপ্রাসাদের বাইরে টুরিস্টদের জন্য পসরা সাজিয়ে বেচছে রঙ্গিন চশমা,
সেলফি স্টিক, ঠাণ্ডা জলের বোতল, ‘মেড ইন চাইনা’ প্লাস্টিকের পুতুল। সবাই শিকড় উপড়ে ভেসে পড়েছে অজানা ভবিষ্যৎ খুঁজতে, সংসার পাততে, রুজিরোজগারের খোঁজে, প্রাণে বাঁচতে। ভিনদেশের
সরকারের নজর বাঁচিয়ে, পুলিশের অত্যাচার থেকে পালিয়ে রোজ লড়ে চলেছে। কেউ হারছে, কেউ জিতছে। বোধহয় একমাত্র ইতিহাস নিঃশব্দে এদের হিসেব রাখছে, যেমন রেখে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

এ গল্প তো আর আজকের নতুন গল্প নয়, উদ্বাস্তুদের এই স্রোত বয়ে চলেছে বহুযুগ ধরে। ইতিহাস ছাড়া কে মনে রেখেছে তাদের? আয়লানের নিথর শরীর আজ যে শরণার্থি সঙ্কট নিয়ে ঝড় তুলেছে
আমাদের মনে, কাল নতুন কোনও ঝড়ের আশঙ্কায় ভুলে যাব আমরা। কিন্তু ইতিহাস কি ভুলতে পারবে যে আদি কাল থেকে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধনীতি, দুর্নীতির মত
নানা শক্ত শক্ত নীতির নিষ্ফলতার বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে এক চিলতে সুখের খোঁজে মানুষ এই উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছে?

মন আমার ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিল, ‘বেলার দিকে একবার পেস্ট কন্ট্রোলের অফিসে ফোন করে পিঁপড়ে মারার ওষুধ আনাতে হবে, নাহলে ওই একটা ফাটল থেকে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে
পিঁপড়েগুলো।’

 

গরমের ছুটির ডাইরি থেকে

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

২৯/০৫/২০১৫, শুক্রবার, বেলা এগারোটা।

“ডাইরি?” মন খিঁচিয়ে উঠল, “আজকাল ডাইরি কোন বোকায় লেখে শুনি? চিরকাল সেকেলেই রয়ে গেলে, আর সেকেলে লেখকদের কেউ আজকাল ঘুরে দেখে না!”
মনের খোঁচা খেয়ে, চোখ পাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, “তা ডাইরি না লিখে কি লিখি তবে?”
“কেন, ফেসবুক অ্যালবাম? হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছবির বন্যা? লাইভ টুইটিং মাই সামার হলিডে ওন টুইটার? এসব ছেড়ে কেউ ডাইরি বা মোটা পিজবোর্ড বাঁধানো অ্যালবাম নিয়ে চিন্তা করে? বল?” বাক্যবাগীশ মন বিজ্ঞের সুরে বলল।
“আচ্ছা, তাই বেশ! এবার মন দিয়ে লেখো,” এই বলে আমি লেখায় মন দিলাম|

বম্বের গরমকাল, হাওয়ায় আম, জাম, কাঁঠাল পাকানো তাত (যদিও এ শহর আম বলতে বোঝে শুধু আলফান্সো, জাম বোঝেই না অ্যার কাঁঠাল খায় না)। রোজ সকালে আকাশ জুড়ে মেঘ করে কিন্তু বেলা এগারো-সাড়ে এগারোটার মধ্যে রোদের তেজে তা সব শুকিয়ে যায়। কাঠফাটা গরম দুপুরের শেষে বিকেলের আকাশ কালো করা, বুক কাঁপানো কালবৈশাখী এখন শুধু স্মৃতি। মন বলে “স্মৃতির আলোয় সব কিছুই মনোরম লাগে, এমন কি ভরা জ্যৈষ্ঠের গনগনে গরম, কলকাতায়ে সাঁইতিরিশ ডিগ্রি চলছে, জানো তো?” – সে যাই হোক, আমি আমার আকাশের সাথে কথা বলা জানালায় পর্দা টেনে সেই স্মৃতির পাতায় হারিয়ে থাকি। ছুটি খুঁজি। আমি আর আমার মন অনেকদিন ধরে এই বম্বের আনরোমান্টিক গরম থেকে ছুটি চাই।

কিন্তু ছুটি চাইলেই কি ছুটি মেলে? তার জন্য অনেক অঙ্ক মেলাতে হয়। কন্যারত্নের স্কুলে গরমের ছুটি পড়লে তবেই আমরা আমাদের ছুটির কথা পাড়ি। তারপর দরকার সদাব্যাস্ত পতিদেবের মার্কিনি কর্তাদের সায়। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতা, ল্যাপটপবাসী গুগুলবাবা, লোনলি প্ল্যানেট – এদের নিয়ে বসে গোলটেবল কনফারেন্স। নানা দেশের ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি দেখে শুনে হিসেব কষে ঠিক হয় ছুটির ঠিকানা।

কিন্তু এই বছরটা যেন প্রয়োজনের চেয়ে বড্ড বেশি লম্বা, প্রচণ্ড গরমে সারা দেশ হাঁসফাঁস করছে, রোজ খবরের কাগজের পাতায় ছাপা হচ্ছে এ বছরের ‘গ্রীষ্মের গ্রাসে মৃতের সংখ্যা’ – বাড়ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রভাবের ত্রাস। কিন্তু আসি আসি করেও আসছে না আমার ভাগের গরমের ছুটি। মানে এখনো এই দাঁড় থেকে শিকলি কেটে ওড়ার সুযোগ দুরস্ত। মন মনে করিয়ে দিলেই কি মনে পড়ে? যেদিকে চোখ রাখি, সেদিকেই দেখি সবাই হয় গরমের ছুটি কাটাতে চলেছে, নয় সামার হলিডে কাটিয়ে ফিরছে। মার্চ, এপ্রিল কেটে মে মাস চলছে কিন্তু ‘ছুটি, তোমার দেখা নাই রে, তোমার দেখা নাই’।

রোজ সকালে মন নানান গজগজানি দিয়ে দিন শুরু করে। “হুঁ! যত্তসব বাড়াবাড়ি! ফোন করে জানাতে হবে ‘উই আর গোয়িং ওঁ এ সামার holiDe!”; “সকাল থেকে ফোন দেখের যো নেই! অমনি পিং, পিং করে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ ঢুকবে। ‘আমরা ইউরোপ ঘুরছি!’ ‘আমরা দেখো নায়াগ্রা ফলসে ভিজছি!’ ‘ভুটান দেখে এলাম!’ ‘পুরিতে সমুদ্র স্নান!’।”; “সেদিন দেখি মাস্কাটের সুলতানের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, সুকের ধারে পোজ মেরে, মেরিনায় বোটে চড়ে ছবি তুলে এক মহিলা কোন এক গ্রুপে লিখেছে ‘আমাদের ইউরোপ ঘোরার ছবি!’ – এমন ঢপের যুগ, বুঝলে!” “তুমি চোখ উল্টেই থাকো। তোমার কথা জানি না, আমার মাথা গরমে কম, এই সব আদিখ্যেতা মারা গরমের ছুটির ছবি দেখে বেশি গরম হচ্ছে!”

আমি নিজেকে আর ক্ষুণ্ণ মনকে ফোন, পাড়াপড়শির কবল থেকে মুক্ত করে একপ্রকার জোর করে গৃহকাজে মন দিই। কিন্তু কাজে মন লাগে কই? উড়ু উড়ু মনকে নিয়ে ফেসবুক বা টুইটার খুললে আরও বিপত্তি! হোয়াটসঅ্যাপ, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব ও তাদের রঙ্গীন সামার হলিডের ছবি যদি ভরা নদীর স্রোত হয়, ইন্টারনেট তো মহাসমুদ্র। পাতার পর পাতা ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের অ্যালবামের বিশাল বিশাল ঢেউ। ছুটি খোঁজা, পলায়নী মন আর আমাকে ভাসিয়ে বেড়ায় নোনা হিংসের ঢেউয়ের স্রোত। বুঝতে পারছি বেশ যে এই পালাই পালাই করা মনের হাত থেকে মুক্তি পাবো না, আর এই বছরের ‘গরমের’ ছুটিও এই পর্য্যন্ত আমাকে লবডঙ্কা দেখিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
হঠাৎ মন গলা বাড়িয়ে শুধাল, “আজ তারিখটা কত?”
“কেন, ২৯শে মে।”
“এবার তাহলে জনসমক্ষে আমাকে হিংসুটে বলে হেয় করা বন্ধ কর, আর আজকের দিনের মাহাত্ম্য কি, তা ভাব।”

মনে পড়ল, আজ বেলাশেষে আমার মেয়ের স্কুলের লম্বা ‘গরমের’ ছুটি শুরু। পতিদেবও সেই খবরে বেশ খুশি মনে আপিস গেছে। মনকে একটা লম্বা ‘সরি’ বলে আমি এবার উঠে রোদের ঝাঁঝ ঢোকার সব রাস্তাগুলো বন্ধ করে, পর্দা নামিয়ে, যাই দেখি আসন্ন আষাঢ়ে যদি আমার ছুটি মকুব হয়, তার দিন গুনতে, নতুন স্মৃতির অ্যালবাম খুলতে, ক্যামেরার পুরানো ছুটির ছোবই ডাউনলোড করে, মেমরি ইরেজ করে নতুন ছবির জায়গা বানাতে চললাম। না পাওয়া গরমের ছুটির থেকে বর্ষা ভেজা ছুটি মন্দ নয়, কি বল মন?
‘দেখা হবে তোমায়ে আমায়ে’ আমার “গরমের ছুটির” পরে!

 

মনের চোরা গলি

শতরঞ্জ কি খিলাড়ির পাতা থেকে।

এ শহরে আমার জানালাটা আকাশের অনেকটা কাছাকাছি। শহর থেকে একটু দূরে, তিনটে ঝিলের পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট কটা টিলার ওপর ছড়িয়ে পড়া এই শহরতলির বুকে আকাশচুম্বী বাড়িগুলোর মধ্যে একটা বাড়ির পঁচিশ তলার ওপর আমার জানালা। ঝকঝকে রোদ উঠলে কখন কখনও দূরে আকাশের পাড়ে সরু রুপালি ফিতের মত আরব সাগর ঝিলিক মারে।

এতদিন লেখালেখি থেকে দূরে থেকে একটু খাপছাড়া লাগছিল, তার সাথে জড় হওয়া আরও অনেক চিন্তার স্রোতে ভেসে ভেসে গিয়ে ঠেকলাম জানালার ধারে। জানালার বাইরে শীতের ছোট্ট দিন শেষ হয়ে ঝুপ করে নেমে এসেছে সন্ধ্যা, নীচের বাড়িগুলো, রাস্তা, দোকান আলোয় আলো, সেই আলোর আভা ঝিলের ধারে আকাশের গায়ে। ঝিলের সাথে গা লাগিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে বড় রাস্তাটা। ঘরমুখো গাড়ির আলোগুলো পিঁপড়ের সারির মত চলেছে রাস্তা বেয়ে, মিলিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে। ওপরে দাঁড়িয়ে নীচে দেখতে বেশ মজা লাগে আমার, বিশেষত মাথায় যখন সারা বিশ্বের নানা চিন্তা কুস্তি করে চলে। অন্ধকারে আলোর মালা, নীচে ছড়িয়ে থাকা শহরতলির ওপর ঘনিয়ে আসা আঁধার, রাস্তায় মানুষের ভীড়, তীরবেগে ছুটে চলা গাড়ি, বাস, অটো – দেখতে দেখতে কখন এক সময়ে মনের ভার হালকা হয়ে যায়, সবকিছু কেমন আবার মনে হয় নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ, সোজা।

চোখ চলে যায় বড় বড় বাড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সরু গলিগলোর দিকে। একটা বাড়ির গা ঘেঁষে বেড়িয়ে এসে, মাথার ওপর ভীড় করে থাকা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, খানিক লুকোচুরি খেলে, আরেকটা বাড়ির পাশ কাটিয়ে, মোড় ঘুরে লুকিয়ে পড়ে আরেকটা বাড়ির আড়ালে। এতো ওপর থেকে নজর করে দেখলে অনেক দূর অবধি দেখা যায় ওদের দৌড়।

মন চলে যায় একছুটে আমার মেয়েবেলার দিনগুলোয়। ক্লান্ত গরম দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা, বিকেলে টিউশানের ক্লাসে পড়তে যাওয়া, পড়াতে যাওয়া, শীতের সন্ধ্যার ঘুপচি অন্ধকারে কলেজ শেষ করে, আড্ডা শেষ করে ঘরমুখে ফেরা। আমি হেঁটে চলেছি, অলি গলি তস্য গলির গোলকধাঁধায়। এক গলির ধাঁধা থেকে বেড়িয়ে আরেক গলির ভুলভুলাইয়ায় গিয়ে পড়া।

মধ্য কলকাতায় বড় হয়েছি তো, গলিঘুঁজির সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। পুরানো পাড়াটা ছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর একটি শাখার প্রশাখা – গলির শেষে কটা দোতলা বাড়ির ঘেরাটোপে বন্ধ। একদিন সেই ঘেরাটোপ ছেড়ে গিয়ে পড়লাম নতুন পাড়ায়, একটা ছোট্ট পার্কের কোণায়, অনেকটা খোলা আকাশের নিচে। একটা নতুন শখ মাথা চাড়া দিল নতুন পাড়ায় এসে, কত তাড়াতাড়ি নতুন ঠিকানার চারিপাশের নতুন নতুন গলিগুলো মুখস্ত করতে পারব। বাবার সাথে বাজি ফেলেছি কতবার, কে আগে খুঁজে বের করবে নতুন গলির গোলোকধাঁধা, চার পাঁচটা অচেনা প্যাঁচ মেরে সোজা পৌঁছে যাবে চেনা কোনোও গলির মুখে। সেই নেশায় কত মজার মজার গলিতে যে ঘুরেছি, ঠা ঠা রোদে পুরানো বাড়ির ঠান্ডা ছায়ায় হেঁটে ফিরেছি কত দিন, ইচ্ছে করে হারিয়ে গেছি কতবার শীতের দুপুরের নরম রোদে। পুরানো বইএর গন্ধের টানে টানে বইপাড়ার অলিতে গলিতে ঘুরেছি কত।

অলি গলি খুঁজে শর্টকাট মারার নেশাটা যে কী মারাত্মক – তায় যদি হাতে থাকে সেই ফেলে আসা শৈশব বা যৌবনের অফুরান সময় – সেই নেশায় যে না ফেঁসেছে তাকে বলে বোঝানো বেশ দুষ্কর। আর এই মাঝবয়সে পৌঁছে সেই নেশা বজায় রাখাও বেশ দুঃসাধ্য। কেন? কেননা সেই নিরবিচ্ছিন্ন, অফুরান সময় কই হাতে? তার বদলে কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির কাঁটা দৌড়েই চলেছে একটা ডেডলাইন থেকে আরেকটা ডেডলাইনে, সময়-এর সংজ্ঞা পালটে গেছে – সে আর অফুরান নয়, দিনটা ঘন্টায় মেপে ভাগ করা, নানা কাজের, দায়িত্বের গন্ডিতে বাঁধা – অবসর নেই, অলি গলি ঘুরে বেড়িয়ে নষ্ট করার মত সময় নেই।

পনেরো বছর ধরে পুরনো শহরটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি আমি। বেশ কটা বড় বড় শহরের বড় রাস্তার ধারে উঁচু উঁচু বাড়িতে বাসা বেঁধেছি। নিজেরও ভাবতে অবাক লাগে যে এত বছরেও এসব শহরগুলোর গলিগুলো আমার কাছে অচেনা। চেনার চেষ্টাও করিনি বেশি। কাজ বেড়েছে, সময় কমেছে, পুরানো নেশাটা তাই ছোটবেলায় তোবড়ানো টিনের বাক্সে জমানো রঙ পেনসিল, পুঁতি, রঙিন কাঁচের টুকরোর, পাথরের সাথে তুলে রেখে দেওয়া হয়ে গেছে আলমারির কোনো লুকানো কোণায়।

তবুও মাঝে মাঝে নতুন কোনও গলির বাঁক চোখে পড়লে মনটা কেমন আনচান করে ওঠে। ফিরে যেতে চায় মন গলিপথে, কিপটের মত তিলে তিলে জমিয়ে রাখা অবসরের লক্ষ্মীরহাঁড়িটা আঁকড়ে ধরে। মনকে সামলাই, মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাই যে খুব শীঘ্রই আসবে সে দিন, ফিরব যেদিন আমার চেনা শহরটায়। শীতের দুপুরে আমার মেয়ের হাত ধরে আবার হারিয়ে যাব বইপাড়ায়, হেঁটে বেড়াব আমার মেয়েবেলার গলিতে গলিতে, আমার নেশাটা ধরিয়ে দেব ওর মনেও।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 29, 2015 in বিভাগবিহীন

 

নীরা-রা

আমার এই সময়ের ব্লগ শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে তুলে দিলাম এই ছোট গল্পটি

নীরা অনেকক্ষণ ধরে গালে হাত দিয়ে রাস্তার ধারে বারান্দাটায় দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের পড়ে আসা নরম আলোয় সামনের সরু একফালি পার্কটার গাছগুলো আকাশের গায়ে নকশার মত দেখাচ্ছে, তাই দেখছিল এক মনে। সদ্য বিগত শীতের হিমেল ছোঁয়া বেলা শেষে কেমন যেন ঠান্ডা ছ্যাঁকা দিচ্ছে গায়ে। পাতলা খদ্দরের চাদরটা আরেকটু গায়ে টেনে নিল নীরা। পার্কটার একদিকে লাল দোলনাগুলোয় এ পাড়ার যত ক্ষুদে মাথাদের ভিড়, দলাদলি, গলাগলি চলেছে পুরো দমে। তাদের সাথে আসা কয়েকজন বৃদ্ধ বসে আছেন একটু দূরে, পাঁচিলের গা ঘেঁষা লোহার বেঞ্চিগুলোয়। নীরা খানিক বোঝার চেষ্টা করল কী কথা চলেছে তাদের মধ্যে। হয়তো বার্দ্ধ্যকের অভিশাপ লাগা জীবনের দায়বদ্ধতার হিসাব নিকাশ করছেন, কে জানে? হঠাৎ স্ট্রোকে মারা যাবার কিছুদিন আগে অবধি ওর ঠাকুর্দা যেমন ওর হাত ধরে পার্কে নিয়ে গিয়ে ওকে ওর বন্ধুদের কাছে ছেড়ে দিয়ে ‘এই বয়সে কি আর ক’মাস বড়ছেলের বাড়ি আর ক’মাস ছোটছেলের বাড়ি – এই চক্কর কাটা চলে…’ এই আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়তেন। গেটের পাশে শৌখিন পাতলা উলের চাদর গায়ে দুই বিগত যৌবনা ঠাকুমা রেলিং-এ হেলান দিয়ে সংসারের প্যাঁচ কষে চলেছেন। বাকী যারা, তাদের মধ্যে চলেছে ‘সাহেব আর ম্যাডামের’ পিন্ডি চটকানো। সারাদিন ‘ডাবল ইনকাম’ ফ্যামিলির ঝি হয়ে সংসারের গিন্নীপনা করা আর বিকেলে এসে সেই বাড়ির সব রসালো গল্প হাটে চাউর করা।

ওদের এই পাড়াটা বড় রাস্তার বাজারটা পেরিয়ে ডানদিকে মোড় ঘুরলেই প্রথম গলি – কিন্তু বড় রাস্তার হৈ হট্টগোল কিছুই টের পাওয়া যায় না। অটো স্ট্যান্ডটা আর ফুলের দোকানটা পেরিয়েই বাঁদিকে গলির ফটকে ঢুকে পড়লেই মনে হয় অন্য জগত। তার ওপর নীরারা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকে, সেটা ওদের গলির প্রায় শেষ মাথায় – আর বেশ সুন্দর দেখতে – দুধারে দুই সারি বাড়ি আর মাঝে এক ফালি পার্ক।

বিয়ের কয়েক মাস বাদেই গোটা আষ্টেক কার্টন, পাঁচটা স্যুটকেস আর দুটো গোদা স্ট্রোলি নিয়ে এসে নেমেছিল কলকাতা রাজধানি থেকে, দিল্লির কাশ্মীরি গেটে। সাথে মাত্র কয়েক মাস পুরানো স্বামী রাতুল। সংসারটিও বেশ পাকা গিন্নীর মতই গুছিয়ে ফেলেছিল ক’সপ্তাহের মধ্যেই। আর গত ছ’মাসে বেশ কটা বন্ধু পাতানোও হয়ে গেছে, কাবেরী, সুদীপা, তমগ্না, সিমরন। ভালোই আছে নীরা। ‘এখন অপেক্ষা কবে এ পাড়ার স্কুল থেকে আমার ইন্তারভিউ কলটা আসে’ মাকে কাল রাতে নীরা বলেছিল ফোনে, ‘দিল্লী এসে তো ছ’মাস হাত গুটিয়ে বসেই আছি।’

স্কুলের চাকরিটা ইচ্ছে করেই নেবে ঠিক করেছে নীরা। কলকাতায় বেশ কয়েক বছর বিজ্ঞাপনের রকমারি মারপ্যাঁচ নিয়ে লড়ে এসেছে একটা অ্যাড এজেন্সিতে, ফর্সা হওয়ার ক্রীম বেচতে আর ভালো লাগে না। ভেবে একটু হাল্কা একটা হাসি খেলে গেল ওর ঠোঁটে।  ক্রীম, সাবান, তেল আর পটাটো চিপস বেচার জন্য কত রকম মিথ্যাই না সাজিয়ে গুজিয়ে রঙ চড়িয়ে বলতে হয়েছে। কলকাতায় তো আবার আরও মজা – বোম্বে থেকে তারকা খচিত বিজ্ঞাপন তৈরি হয় আসত হিন্দিতে, সেগুলোকে শুধু বাংলায় ডাবিং করে চালিয়ে দাও।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল নীরা, হিমেল হাওয়ায় মুক্তির গন্ধ। ও এখন মন দিয়ে রাতুলের সংসার করতে চায় – আর কিচ্ছু না। তাই এ পাড়ার কালিমন্দিরের পাশে বেশ নাম করা একটা স্কুলে ইংলিশ টিচারের চাকরি খালি আছে শুনে গত সপ্তাহে নিজের বায়োডেটা দিয়ে এসেছে। ভালই মাইনে, অনেক ছুটি আর সকাল আটটা থেকে বেলা তিনটে অবধি স্কুল – আর কি চাই? রেলিংটার গা থেকে সরে এসে বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারটায় বসল। টেবিলে উল্টে রাখা বইটা তুলে একটু নাড়াচাড়া করল। বাইরের জানালা দিয়ে টিভির ওপর ওর আর রাতুলের গোয়ায় হানিমুনের ছবিটায় চোখ গেল। রাতুল মিত্র, দিল্লীর নামকরা একটি পি আর এজেন্সীর ভাইস প্রেসিডেন্ট, একটু বেশী মাত্রায় কাজপাগলা – তাই তিন বছরেই এই সংস্থার হিসাবের খাতায় দিন রাত এক করে লাভের অঙ্কে আরও গোটা তিনেক শূণ্য যোগ করেছে আর তরতর করে উপরে উঠে চলেছে। জীবনে একটাই কথা মানে সে ‘দ্য স্কাই ইজ দ্য লিমিট’।

বইটা নামিয়ে রেখে আবার রেলিং-এর ধারেই হেলান দিয়ে দাঁড়ালো নীরা – মাঠের আলোগুলো জ্বালিয়ে দিয়েছে – ঝুপ করে অন্ধকার নেমেছে, তাই মাঠের কোণে কোণে ঘুপচি অন্ধকার।

রাতুলটা কাজ পাগল ঠিকই, কিন্তু বাড়িতে দিনে সে অন্য মানুষ – গান পাগল, বই পাগল, ঘুম কাতুড়ে আর পেটুক। ‘আমার একটাই দোষ, মিথ্যা কথা সহ্য করতে পারি না – অ্যান্ড আই হেট লায়ারস’ প্রায়ই বলে রাতুল। যেন সাবধান করে দেয় নীরাকে। ‘বাট আই লাভ ইউ’ বলেই জড়িয়ে ধরে ওকে। ওর আদরে নিরা অনেক কিছু ভুলতে শিখেছে।

মাঠের গেটে চোখ গেল। ওপরের ফ্ল্যাটের কাবেরীর বর, সমর না? ও আর একটু ঠাহর করে দেখার চেষ্টা করল। কাবেরী তো ছেলেদের নিয়ে বাপেরবাড়ি গেছে, লাখনৌ-এ, ওর বাবার বাৎসরিক। সমরের সাথে ওই বাচ্চা মেয়েটা কে? গলির মুখের বাড়িতে থাকে সুদীপা, ওর মেয়ে বুলবুলির মত লাগল দেখতে। কিন্তু বুলবুলির সাথে তো সুদীপার কাজের মেয়েটা এসেছিল, ও তো ঘন্টা খানেক আগেই বারান্দা থেকে দেখেছে। তবে এখানে এসব খুব আছে, ছেলেমেয়েদের ওপর মা বাবাদের টানটা কেমন ছাড়া ছাড়া – নিজেদের নিয়ে এতই সবাই ব্যাস্ত যে ছেলেমেয়ে বড় হয় ঝি চাকরের হাতে।

কিন্তু নীরার বুকটা কেমন করে উঠল। বুলবুলির হাত ধরে সমর তখন পার্কের গেটের বাইরে বেড়িয়ে গেছে, ওদিকটা একটু দূরে বলে কেমন আবছায়া। আবার সেই গা সিরসির করা, ঘিনঘিনে ভাবটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে, কান, গলা, কাঁধ গড়িয়ে বুকের পাঁজরের ওপরে যেন চেপে বসছে – পাকিয়ে পাকিয়ে নাভিমূল থেকে পায়ের পাতার দিকে নেমে যাচ্ছে। আবার সেই অন্ধকারটা চেপে বসছে মাথার ভিতর – নীরা জানে, এর পরে ওর খুব শীত করবে আর তারপর কুলকুল করে ঘাম বইবে। 

‘ব্রতিদা আর না, ব্যাথা লাগে … আর না … উহ! না! না!’ ও জানে রাতুল ওকে ভালোবাসে, কত ভালোবাসতে চায়। ও নিজেও তো রাতুলকে আঁকড়ে ধরে সব ভুলতে চায়। ব্রতিদা, কলকাতার পুরানো পাড়া, সেই দুপুরগুলো। ‘আহ, আহ… ব্রতিদা… লাগে, বড্ড লাগে…’ ******************************

কলিং বেলটা বেজে উঠল, নীরা চমকে উঠল। এই ভর দুপুরে কে এলো? 

সুতির ওড়নাটা গায়ে টেনে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, এক নজরে ঘড়িতে দেখল বেলা সাড়ে তিনটে। ইস্তিরিওয়ালাটা তো আসবে আরো একটু পরে, তবু বলা যায় না, আজ হয়তো আগে এসেছে। কাল রামসুখ রাতুলের বাড়িতে পড়ার একটা টি শার্টের কলারটা পুড়িয়েছে, তাকে বকতে উদ্যত হয়ে দরজাটা খুলে থমকে গেল। হাতে একটা কাপড়ের ন্যাপকিন ঢাকা প্লেট আর সেই প্লেটের মালকিন কাবেরী একগাল হেসে ওকে ইচ্ছে করে একটু ধাক্কা মেরে ওর পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল।

‘বাব্বা, অমন রাগী মুখ নিয়ে কার জন্য দরজা খুলছিলি? রাতুলের তো ফিরতে এখনও অনেক দেরী?’ ঠাট্টার সুরে কথাটা ছুঁড়ে দিয়ে সোফায় গিয়ে গা ঢেলে দিল কাবেরি।

‘আরে, সে রকম কিচ্ছু নয়! রামসুখ কাল রাতুলের একটা বাড়িতে পরার টিশার্টের কলার পুড়িয়েছে, কিন্তু সেটি তার অতিপ্রিয়, অস্ট্রেলিয়া থেকে বোধহয় তিন বছর আগে এনেছিল, পরে পরে রঙ জ্বলে ভুত হয়ে গেছে, এখনও মায়া ত্যাগ করতে পারেনি!’

‘ভালো রে, পুরানো জামা ফেলে দিতে যার এতো কষ্ট, সে তার নতুন বউকে কত ভালবাসে বল তো? এই রকম ছোট ছোট কথা দিয়েই তো মানুষ চেনা যায়। দেখিস না আমার বরকে, মা বলতে অজ্ঞান, তাই ছেলেদের মাকেও ফেলতে পারে না।’ কাবেরি হেসে প্লেটের থেকে ন্যাপকিনটা সরিয়ে, ওর দিকে বাড়িয়ে দিল। ‘লখনৌ থেকে তো কিছু আনিনি তোর জন্য, আজ বিল্টু আর বুবুর জন্য ব্রেড রোল বানিয়েছি, তাই তোর জন্য নিয়ে এলাম।’

নীরার এই সাবলীল সোজা মানুষটাকে বেশ ভালো লাগে। এই বাড়িরই তিনতলায় স্বামী সমর চৌধুরি, দুই ছেলে বিল্টু আর বুবু আর একটা জার্মান শেপার্ড, ঝুপুকে নিয়ে সুখী সংসার। গত মাস খানেক কাবেরী ছিল না বলে তিনতলাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত – শুধু মাঝে মাঝে সন্ধ্যার মুখে অদ্ভুত গোঙানির আওয়াজটা – কথাটা মনে হতেই কাবেরিকে সোফায় ছেড়ে নীরা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিল। ‘সঙ্গে একটু চা করি? তবে তোমার মত আদা চা-টা করা এখনও রপ্ত হয়নি আমার।’ সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে পড়ল কাবেরি। ‘দাঁড়া, দাঁড়া! আমি করব! কিন্তু এই লাস্ট বার! কাল বিকেলে তোর টার্ন, আমাকে চা করে খাওয়ানোর। আচ্ছা, আমাকে কিন্তু ঠিক পাঁচটায় যেতে হবে। কাল স্কুল খুলবে, তার আগে নবাবপুত্রদের চুল কাটাতে হবে’ – সাবলীল সুরে কথা বলতে বলতে কাবেরি রান্না ঘরে ঢুকে পড়ল। নীরার রান্নাঘরে কোথায় কি থাকে তা কাবেরির নখদর্পণে, যে কেউ দেখলেই বলবে যে তার এ বাড়িতে অবাধ বিচরণ।

রাতুল গত চার বছর ধরে দিল্লীতে আর ততদিন ও এই ফ্ল্যাটেই আছে, নীরাই এ বাড়িতে নতুন সংযোজন। আট মাস আগে যেদিন নীরা রাতুলের সাথে এ বাড়িতে এলো, সোজা সেই কাশ্মীরি গেট থেকে, সেদিন এক তলার মিত্র মাসিমা, তাঁর দুই মেয়ে আর কাবেরি ওকে বরণ করে ঘরে এনেছিল। নিচেকার মেসোমশাই আর মাসিমার সাথে ওদের আর যাই হোক ভাড়াটে-বাড়িওয়ালার সম্পর্ক নয়। মাসিমার মেয়েরাও যখন বাপেরবাড়ি আসে নীরার মনে হয় ওর ননদ এসেছে। নীরা ভালো আছে, ভালোই থাকবে, ও জানে, কিন্তু মাঝেমাঝে বিশ্বাস হয় না। এবার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে হবে।

নিজের মনের অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে কাবেরির দিকে মন দিল। ‘আমার ইন্টারভিউ কল এসেছে স্কুলে, জানো? একটু ভয় করছে – ইন্টারভিউ দিয়ে তো আসি। রাতুল ইজ ভেরী এক্সাইটেড!’

সমর, বুলবুলি, কয়েকটা সন্ধ্যায় ওদের তিনতলার বন্ধ জানালার ভেদ করে ভেসে আসা একটা মৃদু গোঙানি। কাকেই বা বলবে সে এসব কথা? আর তার ফলই বা কী হবে? বুলবুলির কি হবে? আর কাবেরী? সব কিছু তুলে রাখল আরেক দিনের জন্য। হয়তো রাতুলকেই বলবে ও – সব কথা।

*****************************************

‘ব্রতিদা, আর না! না! খুব লাগে! তুমি কথা শুনছ না কেন? ব্রতিদা, নাহ! উফ, না!’ ‘সোনা মেয়ে, একটু আর – তারপর আর ব্যথা লাগবে না’ সেই ফিসফিসে গলার আওয়াজ। ভেজা, তপ্ত ঠোঁটের নোংরা ছোঁয়া। ‘আর একটু, আর একটু … ব্যাস… চুপ, চুপ… আরো আদর করব …’ আবার সেই গলাটা – ‘মনে আছে, এটা আমাদের খেলা। মনে থাকবে? আওয়ার লিটিল সিক্রেট? কাউকে বললে কিন্তু সবাই তোকে খুব বকবে, মা আর বাবা তোকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে আসবে। কাকে মা বলবি তখন? কাউকে বলবি না তো? প্রমিস?’ “নীরা! নীরা! …’ অনেক দূর থেকে রাতুলের গলা ভেসে এলো ওর দুঃস্বপ্নের মধ্যে …

“ব্রতিদা? হু ইজ হী? হু ইজ ব্রতিদা, নীরা?” রাতুল ওকে ঝাঁকাল এবার। “কি হয়েছে তোমার? হোয়াই আর ইউ সোয়েটিং? কি হল?” নীরা জানে রাতুল মিথ্যাকে ঘেন্না করে। আর ও তো সত্যি বলতে পারবে না। রাতুল তো ওকে ঘেন্না করবে। যেমন ও নিজে নিজেকে ঘেন্না করে এসেছে। ঘুমের জাল ছিঁড়ে ও ধড়মড় করে উঠে বসল। আচ্ছন্ন অবস্থাটা মানুষের সব থেকে দুর্বল সময়, চোখ রগড়ে ও ঘুমতা তাড়াতে চেষ্টা করল। “জল দেব?” রাতুলকে বেশ চিন্তিত দেখাল। “আজ প্রথমবার নয়, আগেও অনেকবার তোমায় এই রকম গোঙাতে শুনেছি। আই কুড নেভার মেক আউট হোয়াট ইউ সেড। কি হয়েছে নীরা? ইউ সাউন্ডেড লাইক ইউ ওয়ার ইন এ লট অফ পেইন! আই অ্যাম কনসার্নড!” “মাস্ট হ্যাভ বিন অ্যা ব্যাড ড্রীম, কিছু না! শুয়ে পড়ো, প্লীজ” নীরা আবার এলিয়ে পড়ল বিছানায়। “আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো না, আমি ঘুমিয়ে পড়তে চাই, প্লীজ”

********************************

“আমার কিছুই বলার নেই। এখন তো জানোই কি হয়েছিল, ব্রতিদা কে, কেন আমরা পুরানো পাড়া ছেড়ে চলে এসেছিলাম সল্টলেকের নতুন বাড়িতে? আমায় একটা কথা শুধু বল, মা বাবাকে ফোন করে সব না জানলে জীবনে ঠকে যাবে মনে করেছিলে,না?”

রাতুল চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিল। ঠান্ডা গলায় বলল, “অন্তত ওনাদের এই কথাটা লুকোনো উচিত হয়নি। মিথ্যা বলে…”

“মিথ্যা বলে তোমাকে একটা এঁটো, ছিবড়ে গছিয়ে দিয়েছে, তাই না? কি বলত তোমাকে? যে তাদের অজান্তে তাদেরই আট বছরের মেয়েকে তারই পঁচিশ বছরের পাড়াতুতো দাদা এক মাস ধরে যেদিন ইচ্ছে হয়েছে সেদিনই ছিঁড়ে খেয়েছে? তার ব্যাথা যন্ত্রণা না শুনে তাকে ব্রুটালি রেপ করেছে? আবার ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রেখেছে? জানার পর কি করতে পেরেছিল তারা? ব্রতীন্দ্রকে ধরে আমার বাবা সপাটে থাপ্পড় মেরেছিল – ব্যাস, তারপর মুখ লুকিয়ে ও পাড়া থেকে চলে যেতে হয়েছিল আমাদের! ব্রতীন্দ্র রায় আজও শ্যামবাজারের একই গলিতে সুখে ঘর সংসার করছে – সে খবর পেয়েছ? আর আমার রেপের গল্প জানলে কি করতে? দয়া করে আমাকে উদ্ধার করতে? যাতে তোমার কাছে আমি দাসী হয়ে থাকতাম? নাকি আমাকে না বিয়ে করে একটা ভার্জিন জোগাড় করতে?”

*****************************************

“নীরাদি, তুমি বছরখানেক আগে সি আর পার্কে থাকতে, না? কোন ব্লকে গো?” ঝুমকি খবরের কাগজ হাতে হন্তদন্ত হয়ে নীরার ঘরে এসে ঢুকল।

“কেন রে?” ক্লান্ত গলায় নীরা জানতে চাইল। এখনও কোনোভাবেই ওর মনের ঘা-টা শুকোয়নি। প্রায় এক বছর পর সবকিছু ছেড়ে, সবকিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করে চলেছে নীরা। সেদিন রাতুলের কোনও কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি নীরা – দুটো ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে ওরই কলেজের এক বন্ধুর বাড়ি গিয়ে উঠেছিল। স্কুলের চাকরির ইন্টারভিউ ভালো হলেও বি-এড ডিগ্রি নেই বলে স্কুলের চাকরিটা পায়নি। অগত্যা দিল্লীরই একটা মাঝারি অ্যাড এজেন্সীতে ক্রিয়েটিভ ডাইরেক্টরের চাকরি নিয়ে, হাউজ খাসে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাটে আর তিনটি মেয়ের সাথে থাকে। সবাই জানে ও আর রাতুল আলাদা থাকে। কেন, সেটা জানাবার কোনও কারণ খুঁজে পায়নি।

“জে ব্লকের একজন ‘সম্ভ্রান্ত’ ভদ্রলোক, সমর চৌধুরি, পাড়ারই দুটো বাচ্চা মেয়েকে গত দু বছর ধরে রেপ করে চলেছে – কাল ধরা পড়েছে! তুমি কোন ব্লকে থাকতে? তোমার হাজব্যান্ড … মানে …” ঝুমকি প্রশ্নটা চেপে কাগজটা নীরার বিছানার ওপর মেলে ধরল। খবরটা দেখিয়ে বলল, “এই যে! এ সব লোকগুলোকে জেলে না পাঠিয়ে গুলি করে মারতে হয়।” আজ অনেক দিন বাদে নীরার বুকটা একটু যেন হাল্কা হল। কেউ তো শাস্তি পাবে। বুলবুলির কচি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তারপর কাবেরির মুখটা মনে পড়তেই ওর দুচোখ ফেটে জল এলো।

সন্ধ্যার মুখে রাতুলের ফোনটা এলো।

**********************************

 

চাঁপা ফুলগুলো…

বুড়ো বৃষ্টিভেজা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, ‘সবকো তিশ রুপয়া মে দসঠো দে রাহা হুঁ, আপ বারা লে যাও’। বলে একটা কাঁচা শালপাতায় পনেরোটা সদ্য ফোটা শীতের নরম রোদের মত কুসুম রঙ্গা ফুল মুড়ে, ভেজা সাদা সুতোর রিলটা থেকে খানিকটা সুতো দিয়ে জড়িয়ে, আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।

‘বারা? আপনে তো পনদ্রা দিয়া?’ বুড়ো আগেও এক দিন এইরকম কাজ করেছিল, আমার দেওয়া একশো টাকা থেকে চল্লিশ টাকা কাটার কথা, ফেরত দিলো আশি টাকা। আবার তাকে প্রায় অঙ্ক কষে হিসেব মত টাকা দিয়ে এসেছিলাম।

আমার পাড়ার আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর গোড়ালির কাছে একটা ছোট্টো বাজার আছে। চটজলদির সব পাওয়া যায় – রোজনামচার চাল, ডাল, শাকসব্জি, ফল, মিষ্টিমন্ডা, জলখাবারের টুকিটাকি, ওষুধপত্র, খাতা পেনসিল, ফুল – খুব দরকার পড়লে বোধহয় বাঘের দুধও। তাই নানা কারণে, অকারণে ও পথে আমার যাতায়াত লেগেই থাকে।

এক এক সময় সন্ধ্যা নামার মুখে পৌঁছলে, খবরের কাগজের স্টলটার গা ঘেঁষা, নীচু চওড়া পাঁচিলটার উপর বসে থাকতে দেখি ওই ফুলওয়ালা বুড়োকে। একটা মাঝারি ঝুড়িতে মরসুমি ফুল সাজিয়ে ওই পাঁচিলের উপর বেচতে বসে। গনগনে গরমের পড়ে আসা বেলায় বেল আর জুঁইয়ের মোটা মোটা ‘গজরা’ আর ঝুরো বেল।

সেদিন, এই ঘোর বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরা সাঁঝে দেখি একটা বড় কালো ছাতার তলায় বসে আছে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে। আমায় দেখে মুচক হেসে, হাত নেড়ে ডাকল। এগিয়ে গেলাম। ঝুড়ির একধারে বড় বড় বেলফুলের গজরা আর তার সাথে নরম, কুসুম রঙা কী জানি এক ফুল। বড় সুন্দর ‘খোশবাই’। ওটা আমার

ওটা আমার ঠাকুমার বলা কথা, নাম না জানা ফুলটার গন্ধে মনে পড়ে গেল।

‘দিদি, দেখো আজ চম্পা লায়া, বহুত বড়িয়া খুসবু হ্যায়, আপ আজ মোগরা মত লো, আপ চম্পা লে যাও’ আবদারের সুরে বলল সে। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানকার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভেজা বাতাস চাঁপা ফুলের গন্ধে তখন আরও ভারী হয়ে উঠছে।

champa

ইঁট বের করা, কেঠো, পলেস্তারা খসে পড়া শহরে বড় হয়েছি তো, তাই চাঁপাফুলের কথা অনেক শুনে, বইএ পড়ে চিনেছি, চোখে দেখিনি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়? কলকাতায় কিন্তু চাঁপা ফুলের গাছ আমার চোখে কোনদিন পড়েনি।

বেশ বুঝলাম চাঁপার পাগল করা মিষ্টি গন্ধটা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে, ভেসে যেতে ডাকছে। কবিরা চাঁপার সুবাস নিয়ে কেন এত উদ্বেলিত, তাও এবার বেশ বুঝলাম। তাই বুড়োর আবদার রাখলাম। সে আমায় তিরিশ টাকায় পনেরোটা ফুল দেবেই, বকে ঝকে পঁয়তিরিশ টাকা দিয়ে ফেরার পথে হাঁটা দিলাম।

আজকাল মাঝেমাঝেই সন্ধ্যার মুখোমুখি বাজারে যাই, বিনা কারণে, কখনো বৃষ্টি মাথায় করেই। ফিরে আসি এক মুঠো চাঁপা ফুল হাতে। রাতের দিকে যখন ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, আমাদের পঁচিশ তলার বারান্দার দরজাটা খুলে, অন্ধকারে বসে থাকি দরজার সামনে। আঁধারের ওপারে আলোর মালা, অনেক নীচে বাড়িগুলোয় কমতে থাকে বাতি – আমি বসে দেখি আর গান শুনি। ভেজা হাওয়ায় টেবিলে কাঁচের রেকাবিতে রাখা চাঁপাগুলো ভাসিয়ে দেয় তাদের খোশবাই, লুটিয়ে পড়ে আমার চোখে, মুখে, চুলে। এতোদিন বাদে আলাপ তো, তাই আঁধারের আড়ালে বসে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে একটু, একটু করে গাঢ় করি, আমি আর চাঁপা ফুলগুলো।

picture courtesy : http://www.flickr.com/photos/kgabhi/5643382020/ 
 

চল্লিশ পেরোলেই চালশে?

আমরা বার্ধক্যকে বড় ভয় পাই। ‘বাঘে যদি ধরে, গুপী যদি মরে’, মানে থুত্থুরে বুড়ো হয়ে যাব, চুল পড়ে যাবে, ফোকলা দাঁতে মুরগীর ঠ্যাং চেবাতে পারব না, পেটেও আর পাঁঠার মাংস সইবে না, এইসব চিন্তা আমাদের বুঝি সদাই তাড়িয়ে বেড়ায়। কথাটা মনে ধরল না? ভালো করে কথাটা মাথায় উল্টে, পালটে, ঠুকে, বাজিয়ে, খেলিয়ে দেখুন না একবার?

যদি ভয় না পেতাম তাহলে চারিপাশে এত চল্লিশ-পেরোলেই-চালশেদের – হ্যাঁ, হ্যাঁ, সাহেব, বিবি, গোলাম – সব্বার মধ্যে মসৃণ, নিভাঁজ ত্বক-এর জন্য স্কিন রেজুভেনেটিং ক্রিম, মুখের জেল্লা যাতে ‘ফরেভার টোয়েন্টি ওয়ান’ থাকে তার জন্য নানা লোশন/ময়শ্চারাইজার/আন্ডার আই ক্রিম, বোটক্স, কোমর দেখে যাতে মনে হয় ‘সুইট সিক্সটিন’ তার জন্য লাইপোসাকশান নাহলে সকালে পাড়ার পার্কে পনেরো পাক মর্নিং ওয়াক। তাছাড়া চুলে রঙ, দাঁতে ক্যাপিং/পলিশিং/ফিলিং/ফাইলিং, মাসে দুবার স্পা, ফেসিয়াল, মাস্ক, ম্যানিকিওর/ পেডিকিওর ইত্যাদির এতো রমরমা কেন? তার্কিকেরা অবশ্য নাক বেঁকিয়ে, চোখ পাকিয়ে বলবেই যে এ তো যারা হেডোনিস্টিক, বা বাহ্যিক রূপটাই যাদের কাছে প্রধান, এসব তাদের অ-সুখ, শ্যালো মেন্টালিটি ও দুর্বলতার পরিচয়।

 তাই যদি হয়, তাহলে যাঁরা আপাতদৃষ্টিতে অ-সুখী নন, যাঁরা ‘সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং’-এ বিশ্বাসী বা একটু আঁতেল, জ্ঞানীগুনী ধরনের, তাঁদের কথায় আড়ি পেতে দেখুন না? কেউ ভাবিত, ‘ভিটামিন ডি-র লেভেলটা মনে হচ্ছে একটু কমের দিকে’। কারও মতে,  ‘পঁয়ত্রিশ পেরোলেই ছ’মাস অন্তর এগজেকিউটিভ মেডিক্যাল চেক আপটা রুটিনের মধ্যে এনে ফেলাটা অত্যন্ত দরকার’। ‘শরীরটা রাখতে হবে তো, ভিটামিন আর এসেন্সিয়াল মিনারেল সাপ্লিমেন্ট নাহলে শরীরে খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয় ধরবে’। সেদিন বিকেলে এক পাড়াতুতো বান্ধবীর সাথে দেখা। সাথে পনের বছরের মেয়ে, দাঁতে ব্রেস পরানো। নিজেও দেখি কেমন যেন দাঁত চেপে কথা বলছে। কেন? সকালবেলায় ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে ফাইলিং, সেটিং, প্লাক ক্লিনিং-এর মত কত কি সব খটোমটো কাজকর্ম করিয়ে এসেছে। মন ফিসফিস করে বলল, ‘গত তেতাল্লিস বছরের জমা জঙ্গল সাফ করানো, আর কী?’

আর যারা একটু সাত্বিক প্রকৃতির? সাধনা, ভজনা, কীর্তন, সৎসঙ্গ, বারো মাসে তেরো পার্বণে ছাব্বিশ রকমের উপবাস। সবকিছু কিন্তু সেই একই জায়গায় এসে ভিড়ছে। সবার কামনা একটাই, যত বয়স বাড়বে, রূপে, যৌবনে, স্বাস্থ্যে, পূণ্যে আমার জীবন পরিপূর্ন হয়ে উঠবে, ও জরা, ব্যাধি, এবং বিষেশত বার্দ্ধক্য আমার থেকে দূরে পালাবে।

রবি ঠাকুর বলে গেছেন, “ওই যে প্রবীণ, ওই যে পরম পাকা,/ চক্ষুকর্ণ দুইটি ডানায় ঢাকা,/ ঝিমায় যেন চিত্রপটে আঁকা / অন্ধকারে বন্ধ করা খাঁচায়।”

খুব আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে মাঝবয়স থেকেই সবাই কেমন দিশাহারা হয়ে পড়ে – এই বুঝি ওপারের ডাক পড়ল। একজনের মুখে এও শুনেছি, ‘বাহ! পঞ্চাশ মানেই তো জীবনের ইতি। ষাট-সত্তর হল উপরি পাওনা, বুঝলে?’ তাঁর বয়স? বরজোর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশ। কত লোকে আজকাল চল্লিশের ওপারে জীবন নিয়ে তো বই, ব্লগ, গদ্য, পদ্য কত কি রচনা কর ফেলছে। আবার কারও চুয়াল্লিশে পড়ে মনে পড়ছে যে চুরাশি কেজি বপুটি চৌষট্টিতে না নামাতে পারলে একে একে শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জবাব দিতে আরম্ভ করবে।

কেন এই হতাশা? কিসের ভিতি? কাল আমার জীবনের শেষ দিন হতেই পারে, কিন্তু তার জন্যে আজ থেকে মরে বাঁচতে হবে কেন?

‘জ্ঞান একটু বেশী দেওয়া হয়ে গেল না?’ মন আমার ঘাড় ব্যাঁকাল। ‘এই নাকি তুমি জ্ঞান দাও না? এখানে জ্ঞান জাহির করবে না? জ্ঞান সমুদ্দুরের পাড়ে বসে কেবল নাকি পা দোলাবে? তাহলে কে কিসে ভয় পায়, কার কী দুর্বলতা, কে কী ভাবে জোয়ান থাকার চেষ্টায় মরিয়া, তা নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যাথা কেন?’ কথাটা ঠিক। জ্ঞান দেবার প্রচেষ্টা আমার বিন্দুমাত্র নয়। শুধু অবাক লাগে আর অদম্য ইচ্ছে জাগে জানার যে কী ভেবে বুড়ো বয়সকে মানুষ এতো ভয় পায়? অথর্ব হয়ে পড়বে ভেবে? নিঃসহায়, একাকীত্বের জীবন যাপন করতে হবে বলে? রোগ, জরাকে? নাকি অবশ্যসম্ভাবী সেই দিনের কথা ভেবে, যেদিন সবকিছু ফেলে বিলীন হয়ে যেতে হবে লীনে?

‘এতসব প্রশ্নের উত্তর হয়তো তোমার পাঠক দেবে। তবে ওষুধের হদিশটা আমি বলে দিতে পারি’ বলে মন বুড়ো আঙ্গুলটা নাড়াল, ‘বুড়ো বয়সকে কাঁচকলা দেখাতে পারলেই তো কেল্লা ফতে। চুলে পাক ধরবেই, প্রকৃতির নিয়মে শরীরেও ভাঙ্গন ধরবে, চামড়া কুঁচকে, ঝুলে পড়বে, একটা দুটো করে দাঁত নড়বে আর টুপটাপ খসে পড়বে। তাহলে আসল চাবিকাঠিটি কই? এই আমি, তোমার মন, আমি হলাম চির যৌবনের চাবিকাঠি। আমি তরতাজা, নির্ভীক, নিরুদ্বিগ্ন থাকলেই তুমি “নবীন … আমার কাঁচা”।

তাই বলি কী, মনের জানালাটা খোলা রেখো, বুঝলে ফেলু?” মন বলল, সিধুজ্যাঠার স্টাইলে।

 

শতরঞ্জ কী আনাড়ি

আমার এই সময় ব্লগ, শতরঞ্জ কে আনাড়ির পাতা থেকে ঃ

সদ্য আসন্ন হেমন্তের টুপটাপ পাতা খসানো একটা দিনে, জুরিখের ছোট্ট একটা পার্কে দাঁড়িয়েছিলাম। গেটের সামনেই মাটিতে একটা ছোট চৌকো শান বাঁধানো জায়গা, কতকাল আগেকার সাদা কালো টালি বসিয়ে দাবার ছক বানান। কাঠের ঘুঁটিগুলো বেশ সুন্দর, মাপে এক থেকে দেড় ফুট মত। বিকেলের ঢলে পড়া রোদে পিঠ দিয়ে দুই বৃদ্ধ সেই ছকের মাঝে দাঁড়িয়ে রাজা, রানী, গজ, বোড়ে নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম খানিক, ছবিও তুললাম কটা।

chess players

মন গুরুগম্ভীর সুরে শুধালো, ‘শেখা হয়েছিল দাবা? ছবিগুলো ফেসবুকে লাগিয়ে কি জ্ঞান জাহির করবে শুনি?’ বাবা কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন বটে এবং পরবর্তী কালে আমার পতিদেবও, কিন্তু আমার বেহিসাবি মনের কাছে হার স্বীকার করতে হয়ে দুজনকেই। আমি এখনও তাই শতরঞ্জ কি আনাড়ি।

নাহ, ব্লগের নামটা আমি ধাঁ করে দিয়ে ফেলিনি। নিজেকে নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা, পড়াশোনা করে, নিজের সাথে নানা তর্ক বিতর্ক করেই এই নামে সায় দিয়েছি। মনও উপায় না দেখে, ফোঁস করে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেনে নিয়েছে।

তো, আপনি কোন দলের, শতরঞ্জ কী আনাড়ি না খিলাড়ি? থমকে যাওয়ার কিছু নেই। এই দুটো বিশেষ্যই তো আমাদের আসল পরিচয়। একবার চেয়ে দেখুন চারিপাশে। বিশাল একটা দাবার ছকে দিন রাত আমরা যেন রাজা, রানী, মন্ত্রী, গজ, বোড়ে – এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে বসছি – কেউ ছলে, কেউ কৌশলে, কেউবা স্রেফ বুদ্ধির জোরে টপাটপ বাধা কাটিয়ে, প্রতিপক্ষের রাজাকে ধরাশায়ী করে কিস্তিমাত করছে – শুরু হচ্ছে তার নতুন ছকে নতুন প্রতিপক্ষের সাথে নতুন খেলা। আর কেউ একই ছকে, একই খেলায় বারবার হেরে, ঘুরে মরছে গোলকধাঁধায়।

আমি কেন আনাড়ি? আসলে জনসমক্ষে বুক চিতিয়ে নিজেকে উঁচু দরের খেলোয়ার জাহির করতে বেশ ভয় করে। আশেপাশে আজকাল জ্ঞানীগুণী মানুষের ভীড় ভারি। সবাই কত কিছু নিয়ে চর্চা করে, লেখালেখি গান বাজনা ফটোগ্রাফি এমনকি রান্নাবান্নাও – সবাই সর্বজ্ঞ – তর্ক বিতর্ক চলে কত রকম, চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে তারা আরামকেদারা থেকে পৃথিবীর নানা কোণায় বিপ্লব নিয়ন্ত্রন করে। ধরুন তাদেরই মধ্যে থেকে কেউ খপ করে ধরে যদি জিজ্ঞেস করে “৬৪-র ঘরের নামতাটা বলুন দেখি, তাহলে বুঝব আপনি পাকা খেলোয়ার”। অথবা ধরুন গান শুনছি, তারই মাঝে কেউ ব্যাঘাত ঘটিয়ে বসল, “এই যে হিগস বসন নিয়ে এতো গবেষণা, সেই গড পার্টিকেল-এর হদিস পেলে কি মানুষ শেষমেষ ভগবানের দেখা পাবে?” আর এই সেদিন কি তুফান, ‘মাসলোর মানুষের চাহিদার শ্রেণীবিন্যাসের পিরামিড-এর নীচে, সব থেকে নীচু শ্রেণীর যে মানুষগুলো পিষ্ট হয়ে আছে, তারা যদি হঠাৎ সমাজের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে তাহলে কি আসন্ন প্রজন্মেরা “চাকর” কথার মানে জানতে অভিধান খুলে বসবে?’ বা কেউ যদি চেয়ে বসে মতামত – “এন্ড্রয়েড না আই ফোন?” “ফেসবুক না টুইটার?” “ম্যান ইউ না আরসেনাল?” “কুরোসাওয়া না বার্গম্যান?” “অরহান পামুক নাকি গেব্রিয়েল মার্কেজ?”

বাতাসে বুদবুদের মত অনেক কথা, নানা তথ্য, নতুন মতবাদ আরো কত কি ভেসে বেড়াচ্ছে – কতটুকুই বা আমার নাগালের মধ্যে? ধরতে গেলে, আঙ্গুলের ছোঁয়া লেগে হাওয়ায় মিশে যায় হাওয়া হয়ে। তাই পাকা খেলোয়ার হয়ে উঠতে পারলাম না এখনো।

আমি হতে চাই একটু দলছুট। জ্ঞানীগুণীদের ভিড় এড়িয়ে, নির্নিমেষে বয়ে চলা ঐ জ্ঞানের স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে, পাড়ে বসে পা দোলাব, বিনি পয়সার বায়োস্কোপে দিবাস্বপ্ন দেখব। আমি আনাড়িই ভালো। বাঁধা ছকের ওপর রাজা ক’পা পিছোবে, গজ কাকে আগলাবে, রানী বাঁচাতে ক’টা বোড়ের সর্বনাশ ডেকে আনব – ওই হিসাবটা ঠিক এখনও কষে উঠতে পারিনা।

তার চেয়ে এদিক ওদিক হাঁটকে, এখানে ওখানে কান পেতে – নানা কথার পিঠে কথা গেঁথে, গল্প সাজিয়ে, আসর পেতে আড্ডা মারব, কেমন? প্যাঁচপয়জার, তর্ক বিতর্ক, জ্ঞানগম্যির নাগালের বাইরে – শতরঞ্জ কী আনাড়ির আড্ডা।

 
 
%d bloggers like this: