RSS

তুই আর তোর সাদা কালো ছবিগুলো

05 জানু.

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

“বৃষ্টি ভেজা, সোঁদা মাটির গন্ধ। ভিজে ভিজে আঁধার ঘেরা আকাশ। এক পশলা বৃষ্টিতে হালকা ভিজে দুপুর। ভেজা মন। ভেজা চোখ। ভেজা ভেজা এলোমেলো, সাদা কালো ঝাপসা ক’টা স্মৃতি। তুই আর আমি, একটাই ছাতা, তোর টোল পড়া হাসি, বৃষ্টি ভেজা চুল। আর আমি? এক বছর ধরে শুধু তোর স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে ভিজে চলেছি, রোদঝড়বৃষ্টিতে খুঁজে চলেছি তোকে।”

জানিস, আজ সকালে একটা ভিডিও পেলাম হোয়াটস্যাপে।
সেই ছোট্ট ছেলেটাকে মনে আছে তোর, যার অন্নপ্রাশন আর আমার আইবুড়োভাত দিদা একই দিনে দিয়েছিল? মনে আছে? আমি বোধহয় একটা লাল শাড়ি পড়েছিলাম সেদিন, গলায়ে ছিল দিদার বিয়ের সোনার নেকলেসটা, আমার এলো খোঁপায়ে জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে দিয়েছিলিস তুই। আর সেই ছেলেটা, ছোট্ট ধুতি পড়া গোল গোল পায়ে রুপোর বালা পড়েছিল। সেই ছোট্ট ছেলেটা, যে তোর বাসি বিয়ের দিন রিমি আর পিপলুকে সাথে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের গিটার বাজিয়ে গলা ফাটিয়ে গান গাইছিল? সেই ছেলেটা, তোর আর আমার মামাতো ভাই তাতাই, আজ আবার গিটার বাজিয়ে, গলা ছেড়ে ইংরাজি পপ গান গাইল, আমার চালাক ফোনটার স্ক্রিনে ইউটিউবে দেখলাম। তারপরই মনে হল তোকে ফোন করি, ওই ভিডিওটা নিয়ে গল্প করি, সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ কত বড় হয়ে গেছে, কলেজ ফেস্টে এরকম করে গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে কতগুলো মেয়েকে কাত করবে – তা নিয়ে হাসাহাসি করি, বলি তোকে যে যখন এই ছেলেটা নিজের মনে গুটিয়ে গিয়েছিল, তখন তুই ভাগ্যিস ওর দিকে তোর দুটো হাত বাড়িয়ে রেখেছিলি, ভাগ্যিস তুই ছিলি ওর পাশে ওর কথা শোনার জন্য। ভাগ্যিস তুই ছিলি।

মনে হল আরও গল্প করি। অনেক গল্প করি। কতদিন তোর সাথে প্রাণ মন ভরে আড্ডা মারিনি, আজ ফোন করি। আজ প্রায় এক বছর ধরে তোর সাথে তো শুধু মনে মনেই কথা হয়। ফোন করা হয় না। মেসেজ পাঠানো হয় না। হোয়াটস্যাপ করি না। সেই আগেকার মত তুই ফেসবুকে আমার ছবি লাইক করিস না, কমেন্টও করিস না। তোর সাথে শুধু মনে মনে এক তরফা কথা বলে যাই আমি, সব খবর দিই, ভালো, মন্দ, অপ্রাসঙ্গিক, আমার যত নালিশ, যত ঝগড়া, অভিমানের গল্প, না বোঝা নানা সমস্যার জট যার গেঁড়ো একমাত্র তুই আলগা করে আমাকে বুঝিয়ে দিতে পারিস। কত দিন প্রাণ ভরে পরনিন্দা পরচর্চা থুড়ি পি-এন-পি-সি করিনি বল তো তোর সাথে? তোর সাথে ছাড়া আর কার সাথে করব? কে চেনে এতো লোককে, যাদের শুধু তুই আর আমি চিনি চিরকাল ধরে? কে চেনে মুখোসের পিছনের আসল মানুষগুলোকে, যেভাবে তুই আর আমি চিনি? কে জানে আমাকে এতো কাছ থেকে যেমন করে তুই আমাকে চিনিস? জানিস তোর বলা কথাগুলো থেকে আমি নিজেকে কতটা চিনতে শিখেছি? তুই কি জানিস তোকে বলা কত কথা আমি আর কাউকে বলি না? আমি এও জানি যে তুই আমাকে যে কথাগুলো বলিস তা তুইও আর কাউকে বলিস না। তুই কি জানিস তুই আমার সেতু? কেন? একটু পরে বলব। এখন শুধু বলব, ভাগ্যিস তুই ছিলি।

 

মনে আছে, বম্বের সেই রাতগুলোর কথা? মাঝরাত পেরিয়ে যেত, কাপের পর কাপ ধূমেল চা শেষ হয়ে যেত কিন্তু আড্ডা ফুরতো না। মনে আছে মেয়েবেলার কলকাতার বৃষ্টি ভেজা দুপুরগুলোর কথা, একটা ছাতার নীচে ভিজতে ভিজতে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা? তুই হি হি করে হেসে বলতিস, “দ্যাখ দিদি, আমরা কেমন খাপে খাপে বসে যাই! দুটো ছাতার কি দরকার?”। সন্ধ্যেবেলায় ছাতে বসে থিম্পুর আনা সিগারেটে সুখটান মারা তিনজনে? মনে আছে তোকে শুতে পাঠিয়ে তোর জন্যে রাত জেগেছি, কত ছবি এঁকে দিয়েছি, স্কুলের কাজ করে দিয়েছি আমি? প্রচণ্ড শীতের রাতে ঘুম ভেঙ্গে তোর ঠাণ্ডা গায়ে আবার টেনে দিয়েছি তোর ঠেলে ফেলা লেপ? কলেজ স্কোয়ারে, টাউন স্কুলে, আমার কলেজের পাড়ায়, গড়িয়াহাটে, নিউ মার্কেটে – ফুচকাওয়ালা দেখলেই হল, উপুড় হয়ে ফুচকা খাওয়া? স্কুল থেকে নিজে না খেয়ে তোর জন্য বাঁচিয়ে আনা লজেন্সগুলো? তোর গানের ক্লাস আর হারমোনিয়াম আর আমার মোটা মোটা গল্পের বই। কিন্তু গল্পের বই দেখলে পালাতিস তুই। তবে তুই চিরকালই কি সুন্দর গান গাইতিস, আর আমি? সুরতালজ্ঞানহীন। তুই উত্তম কুমারের ফ্যান আর আমি সৌমিত্রর। পাড়ার পার্কের ধারে বুড়োদাদুর থেকে কেনা আলু কাবলির শালপাতা চেটে চেটে খাওয়া। বিনা কারণে খি খি হেসে গড়াগড়ি যাওয়া। আর আমার ওপর রেগে গেলে, আমার পিঠে বসে আমাকে কাতুকুতু দেওয়া। শীতের দিনে সারাদিন ছাতে রোদে পড়ে থাকা আর গরম পড়লে কাকভোরে সাঁতার শিখতে যাওয়া।

তোকে আমিও পাগল করে দিতাম কাতুকুতু দিয়ে আর আমার প্রিয় গল্পের বইগুলো পড়তে বলে। তুই আমাকে পাগলা করে দিতিস তোর জ্ঞানের বহর দিয়ে। না, মিথ্যা বিদ্যা জাহির করে নয়, সে মেয়ে তুই নয়। তুই চলমান এনসাইক্লোপিডিয়া! প্রশ্ন করলেই উত্তর হাজির। আমি তোর অধ্যবসায়ের কাছে আজও নতি স্বীকার করি। তবে সেটা যে তোর দুর্বলতাও ছিল তা মানবি? মাধ্যমিকের তোর প্রিয়তম সাবজেক্ট হিস্ট্রি পরীক্ষার কথা মনে আছে? মাধ্যমিকের ঠিক এক মাস আগে কাঁদতে কাঁদতে তুই শয্যা নিলি, কেননা তোর নাকি হিস্ট্রি পড়া একদম ভাল করে হয়নি, সাজেশান অনুযায়ী প্রশ্ন উত্তর তৈরি হয়নি, তুই নাকি ফেল করবি হিস্ট্রিতে, এমন কি কোনও প্রশ্ন উত্তরই নাকি তোর লেখা নেই। আমি কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম, তোকে আর হিস্ট্রিকে উদ্ধার করতে। সারা সকাল তোর আর আমার বইয়ের আলমারিগুলো ঘেঁটে শেষে বেরোল গোটা আষ্টেক খাতা, প্রথম থেকে শেষ অবধি ইতিহাসের নানা যুগের উপর প্রশ্ন উত্তরে ভরা। আর একটি বিশেষ প্রশ্ন “ঔরংজেবকে কি মুঘল সালতানাতের পতনের মূল কারণ বলা যায়? উদাহরণ সহ ব্যাখ্যা দাও।” মনে আছে এই কোশ্চেনটির কয়বার আনসার লিখেছিলেন আপনি, দেবী সরস্বতী? সাতবার!

আমার কলেজের দিনগুলো, আমার স্বল্পস্থায়ী ভালোবাসারা, আমার পাওয়া প্রেমপত্রের পাহাড়, তাদের ডাকে সাড়া না দেওয়া, আর যারা আমাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস দিয়ে যেত – তারা? মনে আছে সব তোর, বল? তারপর এলো তোর জীবনে ঝড় তোলা দিনগুলো, তোর প্রথম প্রেম, বাপেরবাড়িতে থাকতে এসে লুকিয়ে পড়া তোর লেখা ডাইরি, ডাইরির পাতায় পাতায় তোর হাতে লেখা নতুন একটা নাম, তোর ইউনিভার্সিটির উত্তাল সন্ধ্যাগুলো। তখন তোর আর আমার মাঝে কয়েক হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব – কিন্তু তোর জীবনে আমার খবরদারি করা আটকাতে পেরেছে কেউ কোনোদিন? তাই তো সেদিন, যেদিন সবকিছু ফেলে চলে গেছিলাম তোর কাছে, তুই আমাকে “আমার সোনা মা, আমার সোনা মা” বলে বুকে টেনে নিয়েছিলি।

আসলে তোকে খুব ভালবাসি। যেদিন প্রথম তোকে কোলে নিলাম, কেউ যেন আমাকে কানেকানে বলে দিল “আজ থেকে তোর কাছে আমার অতি প্রিয় রত্নটিকে গচ্ছিত রাখলাম, দেখিস হারিয়ে ফেলিস না যেন, সামলে রাখিস।” ব্যাস, সেই মুহূর্ত থেকে আমি তোর ওপর দিদিগিরি ফলানোর লাইসেন্স পেয়ে গেলাম।

এখনো মনে পড়লে হাসি পায়, তোর এক অতি প্রিয় কলেজের বন্ধুকে হাত করার জন্য ধরে নিয়ে গেছিলাম কফিহাউসে, প্রচুর চপ কাটলেট আর দু কাপ কফির শেষে সে বলে দিল কার সাথে প্রেম করছিস তুই। আমি বললাম “জানি”। আমার দরকার ছিল অন্য। আর্জি করলাম আমি তার কাছে, যাতে তোর খুব কাছের বন্ধু হিসেবে তোকে বোঝায়ে কি বিরাট ভুল করছিস তুই, যাতে বোঝায়ে সেই ভুল শুধরে নিতে। বিশ্বাস কর, যদি সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারি আবার, আমি আবার সেই এক ভাবেই ঘুষ দিয়ে ভাঙ্গাবো তোর ভুল। বার বার প্রতিবার। যতই রাগ, অভিমান, ঝগড়া – যাই করিস, আমার ভারি বয়েই গেছে।

কেন তুই আমার সেতু? এখনো বুঝলি না? কলকাতা ছেড়ে ভবঘুরে জীবন আমার গত উনিশ বছর, তার মধ্যে আঠারোটা বছর সবার আর আমার মাঝে তুই আমার সেতু। আমি তোর চোখ দিয়ে দেখেছি আমার ফেলে আসা শহরটাকে, দেখেছি তাকে বদলাতে, দেখেছি বয়স বাড়তে সবার, চিনেছি তাদের তোর মাধ্যমে, তোর চোখ দিয়ে দেখেছি তাদের পাল্টে যাওয়া। তোর সূত্রে বাঁধা পড়ে থেকেছি আলগা হয়ে আসা অনেকগুলো সম্পর্কের সাথে, তোর সূত্রে পাতিয়েছি কত নতুন বন্ধুত্ব। আর তুই আমার হয়ে বজায় রেখেছিস পুরনো কিছু সম্পর্কের চাহিদাগুলো, আমার হয়ে পালন করে গেছিস কত দায়িত্ব, আমি দূরে বসে নিশ্চিন্তে, নির্দ্বিধায় ছেড়ে রেখেছি আমার দায়ভার তোর ওপর। ভাগ্যিস তুই ছিলি।

মনে পড়ল সুইডেনের একটা রোদ ঝলমলে দিন থেকে তোর ফোন। কি খুশি খুশি শোনাচ্ছিল তোর গলাটা। তুই বললি “দিদি, আমার সামনে, রাস্তার কোণায় জানিস এক দঙ্গল হলদে রঙের ফুল ফুটে আছে, দেখেই তোর কথা মনে পড়ল! আমি তোর মত হতে চাই, তুই যেমন খুব ছোট্ট ছোট্ট জিনিসে খুশি হয়ে যাস, আমিও সেইরকম হতে চাই!”

সেদিন আমি কাঁদিনি জানিস। আমি মনে মনে নিজেকে বলেছিলাম আমি তোর মত হতে চাই, একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ, যার অনাবিল হাসি ভাসিয়ে দিতে পারে সব দুঃখ, যে সব্বাইকে নিঃস্বার্থের মত আপন করে নিতে পারে, যে আমার সব থেকে আপন। আমার বোন।

ঠিক এক বছর আগে, সেদিন সুইডেন থেকে ফেরার পথে, কোপেনহাগেন এয়ারপোর্টে বাবা দাঁড়িয়ে ছিল তোর দেওয়া সবুজ স্কটিশ মাফলারটা গলায়, বিদেশী ঢঙে ফাঁস দিয়ে জড়িয়ে। বড্ড হ্যান্ডসাম লাগছিল দেখতে। এক লহমায় সব ভুলে গেলাম আমি, মুচকি হেসে ফোনের ক্যামেরায় ছবি তুলতে গেলাম, তোকে হোয়াটস্যাপে পাঠাব “বাপীকে কি হ্যান্ডসাম লাগছে দ্যাখ!” বলে। না, তারপর ছবিও তোলা হয়নি, মেসেজও পাঠানো হয়নি, বাস্তবটা হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল যে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি সারা জীবনের মত।

ছোট্ট থেকে তোর আর আমার দুজনের চোখে ছিল একটাই স্বপ্ন – বুড়ো বয়েসে, পাকা চুল আর ফোকলা দাঁত নিয়ে সেই মেয়েবেলার দিনগুলোর মতন একটা ছাতার তলায়ে ভিজব, কলকাতার বৃষ্টিতে। এক বছর ধরে তুই বৃষ্টি হয়ে টুপটাপ ঝরে চলেছিস, আমার স্বপ্নটা অপূর্ণ রয়ে গেল।

 

 

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান