RSS

সেলফি তুমি কার?

05 জানু.

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

এক বান্ধবীর সাথে প্রায় বছরখানেক বাদে সেদিন হঠাৎ দেখা এক জলসায়ে। এতদিন পরে দেখা, তবুও সে কোনওরকমের গৌরচন্দ্রিকা না করেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে উঠল, ‘তোমার ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচারটা দেখলাম! ঐ যে, যেটায় লিখেছ “সেলফি অ্যাডিক্ট স্ট্রাইকস আগেইন!’ – ছবিটা যা সুন্দর উঠেছে না! মনেই হচ্ছে না যে ওটা সেলফি। আমি তো এবার তোমার থেকে সেলফি তোলার ক্লাস নেব ভাবছি!”

এরকম আলাপচারিতায় কারো কখনো আপত্তি হয় আবার? আমি বিগলিত হাসি হেসে বললাম “আরে দূর, এতে আবার ক্লাস নেওয়ার কি আছে? ক্যামেরাটা ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে মাথার উপর থেকে তাক করবে, বা সোজাসুজি হাসিমুখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বলবে ‘আই লাভ ইউ’ অ্যান্ড ক্লিক! ব্যাস, সেলফি ডান! আপলোড টু ফেসবুক!”
মন বলল “ঢং!”

আমি মনে মনে মনকে সুধালাম, ‘কেন? এতে ঢঙের কি হল? কি করলে কি হয়, সব খবর কি তুমি রাখ? কোনোদিন নিজের সেলফি তুলেছ?’

“নারসিসাসের নাম শুনেছ? গ্রিক মাইথলজি পড়েছিলে? ব্যাটা জলে নিজের ছায়া দেখে নিজের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিল, তা জানো নিশ্চয়ই?” আমার মনের এই এক স্বভাব, যত্র তত্র যাঁহা তাঁহা ঝাঁপি খুলে বসে জ্ঞান বিতরণ করতে শুরু করে। আমি আপাতত মনের গলা টিপে বন্ধু, জলসা, গানবাজনা, নিজের প্রশংসা শোনার দিকে মন দিলাম। মন মনে মনে ‘নারসিসাস, নারসিসাস, নারসিসাস, নারসিসাস …’ বলে আমাকে গাল পাড়তে থাকল।

রাতে বাড়ি ফিরে মনের কানে আলতো মোচড় মেরে বললাম “তুমি ভারি হিংসুটে! আমার সেলফিকে সুন্দর বলা মানে কি তোমাকে সুন্দর বলা নয়? তাই বলে তুমি আমাকে যা পারো কটু কথা শোনাবে? হিংসুটে, হিংসুটে, হিংসুটে!”
মন উদাস ভাবে মাথা নাড়ল। “যার তরে করি চুরি, সেই কয় চোর। আচ্ছা, বল দেখি, তুমি সেলফি তোল কেন?”
বাইরে এখন নিস্তব্ধ, অন্ধকারে থমকে থাকা রাত, অনেক নীচে জেগে আছে শুধু পাড়ার সারমেয়র দল। কোথায়ে এখন আরাম করে ঘুমোব, না এখন আমাকে মনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে আমার সেলফি তোলা নিয়ে?
“রাখো তোমার গোয়েন্দাগিরি, এখন অনেক রাত, নিজে ঘুমোও আর আমাকেও ঘুমোতে দাও। কাল সকালে তোমার উত্তর দেবখন, কেমন?”

মন একটু গাল ফুলিয়ে চুপ করল, কিন্তু আমার মাথায়ে হঠাৎ প্রশ্নটা কেমন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, নট নড়নচড়ন কিচ্ছু।
আমি তো সেলফি নিজের জন্যই তুলি, না?
মন বলল, “না, একদম না।”
তাহলে?
“যাতে ফেসবুকে, টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপের ‘ফ্রেন্ড লিস্টে’ তোমার যত খেঁদি, বুঁচি, টেঁপির মা আছে, এবং আনাচে কানাচে তোমার যত সব প্রাক্তন প্রেমিকরা আছে, তাদের সব্বার গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য।”

সে আবার কি কথা? আমি মানছি, আমি আজকাল একটু বেশিই ছবি তুলি নিজের। সেজেগুজে কোথাও যাবার সময়ে মনে হয় না বুঝি একবার দেখে নিই সাজটা কেমন হল? আয়নায় তো দেখলামই, সেই সাজের একটা ছবি তুলে রাখলে কি এমন ক্ষতি হয় কার? অবসরে বেশ ফোনের অ্যালবাম খুলে দেখতে পারি আমার নানা সাজগোজ, আমার নানা রূপ, নানা মুডের ছবি। আর তো বেশি দিন এই বয়স, এই চেহারা থাকবে না, সময়ের নিয়মে বয়স ঢলবে, চেহারা, মুখের আদল বদলাবে, পাল্টে যাবে পৃথিবীকে, নিজেকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিও হয়তো, বদলে যাবে সাজের ধারা, বাড়বে নাহলে কমবে সাজের বহর। তাই আমি হয়তো ধরে রাখতে চাই নিজেকে এই ছবিগুলোর ফ্রেমে, হয়তো বেঁধে রাখতে চাই এই সময়টাকে, যাতে জীবনের সায়াহ্নে বসে একপাক ঘুরে যেতে পারি এই সময়ে।

Taking A Selfie, Trafalgar Square, London, UK

মাঝে মাঝে যখন আবার তোমার মনের মত সাজি, তখন মনে হয় তুমি একবার চোখ তুলে চেয়ে বলবে ‘বাহ!’। কখনও কখনো তোমার ফোনের আর ল্যাপটপের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি পড়ে যাই হিসেবের বাইরে, অতীতে সেই সব সময়গুলো হয়ে দাঁড়াত দাম্পত্য কলহের কারণ – এখন সে সব সমস্যার সমাধান একটাই – সেলফি তুলে রাখি, এখন সময় না থাকলে পরে তোমার ফুরসতে তুমি যখন ফেসবুক বা টুইটার দেখবে, তখন হয়তো আমার ছবিটা দেখে বলবে ‘বাহ!’ – মুগ্ধ হবে আগেকার মত, হোক না তা ভারচুয়ালি।

ও, আরও একটা কারণ আছে। সব্বাইকে দেখি কেমন নানা পোজে, আঁকাবাঁকা নদীর মত এদিকে ওদিকে কাত হয়ে ছবি তোলায়ে একে ওকে তাকে দিয়ে। দিব্যি স্মার্টলি স্মার্ট ফোনটা কারো হাতে সোজা ধরিয়ে দিয়ে শাড়ি গয়না গুছিয়ে, চুলটা এলো করে, দাঁড়িয়ে পড়ে ঘাড় কাৎ করে ক্যামেরার সামনে। আমি না ছিঁচকাঁদুনের মত যাকে তাকে ধরে বলতে পারি না, “আমার একটা ছবি তুলে দাও না, প্লীজ!” আমি লুকিয়ে চুরিয়ে নিরালায় বসে নিজেই নিজের ছবি তুলি। বেশ একটা স্বাধীনতা আছে নিজের হাতে নিজের ছবি তোলার – কেমন নির্দ্বিধায় নানা মুখভঙ্গি করে, হেসে, দাঁড়িয়ে, বসে, যে কোন ভাবে ইচ্ছে, যতগুলো ইচ্ছে, কেউ বিরক্ত হবে না বা বুড়ো বয়সের ঢং বলে ব্যাঙ্গও করবে না – দরকার শুধু একটু নিজেকে ভালোবাসা।

মন আড়মোড়া ভেঙ্গে, ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “স্বীকার করলে তাহলে গভীর আত্মপ্রেম অর্থাৎ নারসিসিজমই এসব বেহেড কাজকর্মের মূল কারণ? নিজেকে ভালোবাসলে, সেই ভালোবাসার প্রতিফলন কি মাথার উপর পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকেই বোঝা যায়? নাকি মুখটা বেঁকিয়ে, কি বলে বেশ, হ্যাঁ ‘পাউট’ করে ছবি তুললেই বেশ পৃথিবী বোঝে তুমি কত নিজেকে ভালোবাসো? ছোট ছোট মেয়েগুলোকে দেখেছ, তেরো থেকে তেত্রিশ? তোমাদের মত বুড়িদের থেকে তারা আরও দুই পা এগিয়ে! ঘুম থেকে চোখ খুলে সেলফি, চান করা ভেজা চুলে সেলফি, হাতে নতুন রঙের নেলপালিশ পড়ে সেলফি। বন্ধু পাতালে? সেলফি। প্রেমে পড়লে? সেলফি। নতুন জামা কিনতে গিয়ে? সেলফি। মলের জামাকাপড়ের ট্রায়াল রুমে নতুন নতুন প্রতিটা জামা পড়ে পড়ে দেখার সময়? সেলফি। গান শুনতে, সাবওয়ে খেতে, স্কুলে/কলেজে/অফিসে যেতে আসতে, রাস্তায়ে হাঁটতে হাঁটতে, বিয়েবাড়িতে, পার্টিতে, নাচতে নাচতে, আর প্রাণ যা চায় সব কিছুর – চাই একাধিক সেলফি। আজকাল দেখ কচি কি দামড়া, ছেলেগুলোও গাছের তলায়, বাইকে বসে, মেয়ের কাঁধে হাত রেখে, বিয়ারের বোতলে ঠোঁট ছুঁইয়ে, সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে, চোখ মটকে, রকস্টারদের মত নানা পোজ মেরে সেলফি তোলে!”
মনের ঘুম দেখলাম উড়ে গেছে।

“কিন্তু, আমি দিনে দশ গণ্ডা ছবিও তুলি না নিজের, না আমি অন্যদের মত ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফেসবুকে সেলফি আপলোড করি। আর ওই কচি কাঁচাদের মত সবসময়ে সব কিছুর মধ্যে নিজেকে ওরকম হারিয়ে ফেলি না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে গত কয়েক বছরে সেলফি ফিভারে সব্বাই কাবু, সেলফি অ্যাডিকশান এখন সব থেকে তুঙ্গে। মনে আছে গতবছর জুলাই মাসে ইটালিতে কি কাণ্ড দেখে এলাম? এই লম্বা লম্বা সেলফি স্টিক নিয়ে ঘুরছে সব টুরিস্টরা, কোথাও দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কিছু দেখার উপায় নেই, চোখের সামনে শুধু সেলফি স্টিকের ভিড় – সে মাইকেলএঞ্জেলোর মাস্টারপিস ডেভিডের স্ট্যাচুই হোক বা আড়াই হাজার বছরের পুরানো কোলোসিয়াম, মিলানের ফ্যাশান কোয়াডিল্যাটারাল অথবা ভেনিসের রিয়াল্টো ব্রিজ, রোমের টিবের নদীর পাড়ে মেলায়ে, ফ্লোরেন্সে আরনোর পাড়ে সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে, পিজার হেলানো টাওয়ারে, কাপ্রি দ্বীপের নীল জলে – এমন কি ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকার প্রতিটা কোণায় কোণায় – কেউ কিছু আর চোখ দিয়ে দেখে না, মনে ধরে রাখতে চায় না, সব জায়গায় খালি ফোনের ক্যামেরার সামনে নিজের মাথা গুঁজে সেলফি তুলে বন্দি করে রাখতে চায়। এমনকি মন্ত্রীরা খরা পরিদর্শনে গিয়ে আজকাল সেলফি তোলে। যাচ্ছেতাই!”

“এগজ্যাক্টলি! যাচ্ছেতাই-ই বটে!”

ঘুম কোন আইন মানে না, হঠাৎ হানা দেয় যাকে তাকে যেখানে সেখানে। এই রকম গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিস্কাশানের মাঝখানে আমি হঠাৎ দেখলাম আমি ঢুলে পরেছি আর মনও মুখ গোমড়া করে দাঁড়ে বসে ঝিমোচ্ছে। এই সুযোগ কি কেউ আর ছাড়ে, আমিও পাশ ফিরে তলিয়ে গেলাম ঘুমের অতল নিস্তব্ধতায়। মনকে ফিসফিস করে বলে রাখলাম “এ গপ্পের অনেক লম্বা লেজ, এক রাতে ফুরোবে না, এখন ঘুমোও – বাকি কথা কাল হবে।”

কিন্তু কাল ‘আসি, আসি’ করেও আর এলো না। উল্টে আমি মাসখানেকের জন্য কাত হয়ে পড়লাম নানা ছোটখাটো রোগের ধাক্কায়। এমন কাত হলাম যে মাথা তোলার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে গেল দিনকতক। বিছানায় শুয়ে শুয়েই বিশ্বভ্রমণ, পাড়াবেড়ানো, পরনিন্দা পরচর্চা, প্রেম, অনুরাগ, বিরাগ, ঝগড়া, ভাব ইত্যাদির মত গুরুত্বপূর্ন সব কাজকর্ম ফোনে, মোবাইল ফোনে, অনলাইন ইথারের তরঙ্গে হল সে কদিন।
এরই মাঝে ফেসবুক খুলে একদিন কি যেন দেখছি, হঠাৎ কি মনে করে খুললাম আমার সেই কুখ্যাত সেলফি প্রোফাইল পিকচার।

বেশ ঝলমলে একটা দিনে খোলা জানালার পাশে এলোচুলে দাঁড়িয়ে ছিলাম বোধহয়, রোদের ঝলক চুলে, চোখে, টিপে – কি জানি নিজের কোন খেয়ালে নিজের দিকে তাকিয়েই হাসছি, হারিয়ে আছি নিজের মধ্যে আমি, নিজের খেয়ালে – যেন সেই মুহূর্তটা শুধু আমার, তাতে আর কারো প্রবেশ নিষেধ। নিজের সাথে এই অন্তরঙ্গতা দেখে মনটা বেশ ভরে গেলো।

না, কোনও নার্সিসিজম চোখে পড়ল না তো। না কোনওরকমের আগলছাড়া, পাগলপারা আত্মপ্রেম। আমার সেলফি, আমারই মত, আমার নিজের সাথে কাটানো একটা সুন্দর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি মাত্র, কোন দুর্বল মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি নয়।

“থাক, এই ছবিটা পাল্টিও না তাহলে।” বলে মন ফুরর করে উড়ে গিয়ে দাঁড়ে বসে নিজকাজে মন দিল।

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: