RSS

যতসব উদ্বাস্তুর দল!

05 জানু.

শতরঞ্জ কি আনাড়ির পাতা থেকে।

ক’দিন ধরেই দেখছি জানালার পাশে রাখা পাতা বাহারটার টব থেকে লাইন করে এক দল কালো পিঁপড়ে পাশেই রাখা বইয়ের আলমারির পিছনে সেঁধোচ্ছে। প্রতিদিন, নিয়ম করে। আজও সকালে
দেখলাম তাদের নিয়মের কোন বেনিয়ম হয়নি। টব থেকে আলমারির পিছনে দেওয়ালের ফাটল অব্দি পিঁপড়ের সার হেঁটে চলেছে।

“উদ্বাস্তু, উদ্বাস্তু!” মন বলল, “গরমের ছুটি কাটাতে যাবার সময় গাছের টবগুলোকে নীচের উঠোনে হাওয়া খেতে পাঠিয়েছিলে, সেই উঠোনের টালির ফাটল থেকে পিঁপড়েগুলো এসে বাসা বেঁধেছিল
তোমার টবে। এখন আরও পাকাপাকি সংসার পাততে ঢুকছে তোমার দেওয়ালের ফাটলে। যতসব উদ্বাস্তুর দল!”
সামনে চায়ের কাপের তলায়ে চাপা খবরের কাগজটা আমার মন পাওয়ার আশায় ফরফর করে চলেছে। আমি তাকে সাময়িক ভাবে এড়িয়ে, আমার বুদ্ধিমতী আই ফোনটিকে হাতে নিলাম। এক সপ্তাহ
ধরে নানা কাজের চাপে অনেক গুলো ভালো ভালো প্রবন্ধ এদিক ওদিক থেকে জমা হয়েছে সাফারির বুকমার্কে, ‘সবার আগে ওগুলো আজ পড়তেই হবে’ মনে করে বসেছি। তাই সেদিকে মন দিলাম।
কিন্তু মাথায়ে আমার ‘উদ্বাস্তু’ কথাটা থমকে থেকে গেলো।

মনে পড়ল সারা বিশ্বে ঝড় তোলা সেই ছবিটা – শান্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ে লাল শার্ট পড়া ছোট্ট খোকার নিঃস্পন্দ শরীর। ছবিটা এক নজর দেখলে মনে হয় দুষ্টুমি করে জলের ধারে গা গড়িয়ে দিয়েছে
খোকা, খেলছে হাল্কা ছলকানো ঢেউয়ের সাথে, এখনি উঠে দৌড়ে যাবে, ঝাঁপিয়ে পড়বে মায়ের কোলে, খিলখিলিয়ে হেসে ভিজিয়ে দেবে মায়ের মন, মুখ, শরীর। আমি কতদিন এই ছবিটাই বিশ্বাস
করতে চেয়েছি, মানতে চাইনি মায়ের শিথিল হয়ে আসা হাতের আগল থেকে আয়লানের ছোট্ট শরীরটা তলিয়ে গেছিল ঝড়ে উত্তাল সমুদ্রে, ঢেউয়ের ধাক্কায় আছড়ে পড়েছিল তুরস্কের সাগরতীরে।
কেন? কেননা তার মা বা বাবা চায়নি সিরিয়ার যুদ্ধের বোমার শিকার হতে, চায়নি আয়লান আর তার ভাইয়েরা একটু বড় হয়েই হাতে তুলে নিক বড় বড় বন্দুক, প্রাণ দিক দেশের গৃহযুদ্ধে। তারা
চেয়েছিল সময় থাকতে গিয়ে উঠতে ইউরোপের কোনও দেশে, তারপর পাড়ি দিতে সুদূর কানাডায়, যাতে তাদের জীবনে ফিরে আসে একটুখানি শান্তি, খানিকটা নিশ্চিন্ত, নিরুপদ্রব, নিশ্চল স্থায়িত্ব।

migrant-child-dead-beach-turkey.jpg

ওই পিঁপড়ের সারির মত লাখে লাখে মানুষ সব কিছু ছেড়ে, শেকড় উপড়ে ভেসে পড়ছে অজানা সাগরে রোজ, শুধু যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্য প্রাচ্য থেকেই নয়, আফ্রিকার নানা গৃহযুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ ছেড়ে, দক্ষিণ
এশীয় দেশগুলোও ছেড়ে, দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকেও। কেউ পালাচ্ছে যুদ্ধের থেকে, কেউ পালাচ্ছে না খেতে পেয়ে, কেউ পালাচ্ছে খরা থেকে, তো কেউ বন্যার থেকে। সব্বাই পাড়ি দিচ্ছে
আপাতশান্ত, আপাতস্বচ্ছল দেশগুলোর দিকে। সবার একটাই লক্ষ্য, যাতে প্রাণ বাঁচে, যাতে তারা অন্য কোথাও গড়ে তুলতে পারে নিরাপদ জীবন, নিজের আর আপনজনেদের জন্য।

যে কোনও ছুটির বাহানায় যখনই নিজের গণ্ডীর বাইরে বেড়িয়ে দেশবিদেশের নানা শহরে যাই, চোখে পড়ে কোনও গলির বাঁকে, সদর রাস্তায়, বাজারের ভিড়ে মাথা নিচু করে ভিক্ষা চাইছে কেউ,
সামনে কাঁপা হাতে বাঁকাচোরা অক্ষরে লেখা আবেদন – বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বক্তব্য “আমি অমুক দেশ থেকে আসা শরণার্থি – আমাকে সাহায্য কর”। কেউ ইরাকের, কেউ প্যালেস্টাইনের, কেউ বা
এসেছে কাশ্মীর, আফগানিস্তান, মায়ানমার, উগান্ডা, নাইজিরিয়া থেকে। আবার কখনও চোখে পড়ে মন্দির, গির্জা, মিউজিয়াম, রাজপ্রাসাদের বাইরে টুরিস্টদের জন্য পসরা সাজিয়ে বেচছে রঙ্গিন চশমা,
সেলফি স্টিক, ঠাণ্ডা জলের বোতল, ‘মেড ইন চাইনা’ প্লাস্টিকের পুতুল। সবাই শিকড় উপড়ে ভেসে পড়েছে অজানা ভবিষ্যৎ খুঁজতে, সংসার পাততে, রুজিরোজগারের খোঁজে, প্রাণে বাঁচতে। ভিনদেশের
সরকারের নজর বাঁচিয়ে, পুলিশের অত্যাচার থেকে পালিয়ে রোজ লড়ে চলেছে। কেউ হারছে, কেউ জিতছে। বোধহয় একমাত্র ইতিহাস নিঃশব্দে এদের হিসেব রাখছে, যেমন রেখে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

এ গল্প তো আর আজকের নতুন গল্প নয়, উদ্বাস্তুদের এই স্রোত বয়ে চলেছে বহুযুগ ধরে। ইতিহাস ছাড়া কে মনে রেখেছে তাদের? আয়লানের নিথর শরীর আজ যে শরণার্থি সঙ্কট নিয়ে ঝড় তুলেছে
আমাদের মনে, কাল নতুন কোনও ঝড়ের আশঙ্কায় ভুলে যাব আমরা। কিন্তু ইতিহাস কি ভুলতে পারবে যে আদি কাল থেকে রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, কূটনীতি, যুদ্ধনীতি, দুর্নীতির মত
নানা শক্ত শক্ত নীতির নিষ্ফলতার বিশাল বোঝা কাঁধে নিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে এক চিলতে সুখের খোঁজে মানুষ এই উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছে?

মন আমার ফিসফিস করে মনে করিয়ে দিল, ‘বেলার দিকে একবার পেস্ট কন্ট্রোলের অফিসে ফোন করে পিঁপড়ে মারার ওষুধ আনাতে হবে, নাহলে ওই একটা ফাটল থেকে সারা বাড়িতে ছড়িয়ে পড়বে
পিঁপড়েগুলো।’

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: