RSS

মনের চোরা গলি

29 সেপ্টে.

শতরঞ্জ কি খিলাড়ির পাতা থেকে।

এ শহরে আমার জানালাটা আকাশের অনেকটা কাছাকাছি। শহর থেকে একটু দূরে, তিনটে ঝিলের পাড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট কটা টিলার ওপর ছড়িয়ে পড়া এই শহরতলির বুকে আকাশচুম্বী বাড়িগুলোর মধ্যে একটা বাড়ির পঁচিশ তলার ওপর আমার জানালা। ঝকঝকে রোদ উঠলে কখন কখনও দূরে আকাশের পাড়ে সরু রুপালি ফিতের মত আরব সাগর ঝিলিক মারে।

এতদিন লেখালেখি থেকে দূরে থেকে একটু খাপছাড়া লাগছিল, তার সাথে জড় হওয়া আরও অনেক চিন্তার স্রোতে ভেসে ভেসে গিয়ে ঠেকলাম জানালার ধারে। জানালার বাইরে শীতের ছোট্ট দিন শেষ হয়ে ঝুপ করে নেমে এসেছে সন্ধ্যা, নীচের বাড়িগুলো, রাস্তা, দোকান আলোয় আলো, সেই আলোর আভা ঝিলের ধারে আকাশের গায়ে। ঝিলের সাথে গা লাগিয়ে এঁকে বেঁকে চলে গেছে বড় রাস্তাটা। ঘরমুখো গাড়ির আলোগুলো পিঁপড়ের সারির মত চলেছে রাস্তা বেয়ে, মিলিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে। ওপরে দাঁড়িয়ে নীচে দেখতে বেশ মজা লাগে আমার, বিশেষত মাথায় যখন সারা বিশ্বের নানা চিন্তা কুস্তি করে চলে। অন্ধকারে আলোর মালা, নীচে ছড়িয়ে থাকা শহরতলির ওপর ঘনিয়ে আসা আঁধার, রাস্তায় মানুষের ভীড়, তীরবেগে ছুটে চলা গাড়ি, বাস, অটো – দেখতে দেখতে কখন এক সময়ে মনের ভার হালকা হয়ে যায়, সবকিছু কেমন আবার মনে হয় নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বেগ, সোজা।

চোখ চলে যায় বড় বড় বাড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সরু গলিগলোর দিকে। একটা বাড়ির গা ঘেঁষে বেড়িয়ে এসে, মাথার ওপর ভীড় করে থাকা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে, খানিক লুকোচুরি খেলে, আরেকটা বাড়ির পাশ কাটিয়ে, মোড় ঘুরে লুকিয়ে পড়ে আরেকটা বাড়ির আড়ালে। এতো ওপর থেকে নজর করে দেখলে অনেক দূর অবধি দেখা যায় ওদের দৌড়।

মন চলে যায় একছুটে আমার মেয়েবেলার দিনগুলোয়। ক্লান্ত গরম দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা, বিকেলে টিউশানের ক্লাসে পড়তে যাওয়া, পড়াতে যাওয়া, শীতের সন্ধ্যার ঘুপচি অন্ধকারে কলেজ শেষ করে, আড্ডা শেষ করে ঘরমুখে ফেরা। আমি হেঁটে চলেছি, অলি গলি তস্য গলির গোলকধাঁধায়। এক গলির ধাঁধা থেকে বেড়িয়ে আরেক গলির ভুলভুলাইয়ায় গিয়ে পড়া।

মধ্য কলকাতায় বড় হয়েছি তো, গলিঘুঁজির সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। পুরানো পাড়াটা ছিল সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর একটি শাখার প্রশাখা – গলির শেষে কটা দোতলা বাড়ির ঘেরাটোপে বন্ধ। একদিন সেই ঘেরাটোপ ছেড়ে গিয়ে পড়লাম নতুন পাড়ায়, একটা ছোট্ট পার্কের কোণায়, অনেকটা খোলা আকাশের নিচে। একটা নতুন শখ মাথা চাড়া দিল নতুন পাড়ায় এসে, কত তাড়াতাড়ি নতুন ঠিকানার চারিপাশের নতুন নতুন গলিগুলো মুখস্ত করতে পারব। বাবার সাথে বাজি ফেলেছি কতবার, কে আগে খুঁজে বের করবে নতুন গলির গোলোকধাঁধা, চার পাঁচটা অচেনা প্যাঁচ মেরে সোজা পৌঁছে যাবে চেনা কোনোও গলির মুখে। সেই নেশায় কত মজার মজার গলিতে যে ঘুরেছি, ঠা ঠা রোদে পুরানো বাড়ির ঠান্ডা ছায়ায় হেঁটে ফিরেছি কত দিন, ইচ্ছে করে হারিয়ে গেছি কতবার শীতের দুপুরের নরম রোদে। পুরানো বইএর গন্ধের টানে টানে বইপাড়ার অলিতে গলিতে ঘুরেছি কত।

অলি গলি খুঁজে শর্টকাট মারার নেশাটা যে কী মারাত্মক – তায় যদি হাতে থাকে সেই ফেলে আসা শৈশব বা যৌবনের অফুরান সময় – সেই নেশায় যে না ফেঁসেছে তাকে বলে বোঝানো বেশ দুষ্কর। আর এই মাঝবয়সে পৌঁছে সেই নেশা বজায় রাখাও বেশ দুঃসাধ্য। কেন? কেননা সেই নিরবিচ্ছিন্ন, অফুরান সময় কই হাতে? তার বদলে কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির কাঁটা দৌড়েই চলেছে একটা ডেডলাইন থেকে আরেকটা ডেডলাইনে, সময়-এর সংজ্ঞা পালটে গেছে – সে আর অফুরান নয়, দিনটা ঘন্টায় মেপে ভাগ করা, নানা কাজের, দায়িত্বের গন্ডিতে বাঁধা – অবসর নেই, অলি গলি ঘুরে বেড়িয়ে নষ্ট করার মত সময় নেই।

পনেরো বছর ধরে পুরনো শহরটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি আমি। বেশ কটা বড় বড় শহরের বড় রাস্তার ধারে উঁচু উঁচু বাড়িতে বাসা বেঁধেছি। নিজেরও ভাবতে অবাক লাগে যে এত বছরেও এসব শহরগুলোর গলিগুলো আমার কাছে অচেনা। চেনার চেষ্টাও করিনি বেশি। কাজ বেড়েছে, সময় কমেছে, পুরানো নেশাটা তাই ছোটবেলায় তোবড়ানো টিনের বাক্সে জমানো রঙ পেনসিল, পুঁতি, রঙিন কাঁচের টুকরোর, পাথরের সাথে তুলে রেখে দেওয়া হয়ে গেছে আলমারির কোনো লুকানো কোণায়।

তবুও মাঝে মাঝে নতুন কোনও গলির বাঁক চোখে পড়লে মনটা কেমন আনচান করে ওঠে। ফিরে যেতে চায় মন গলিপথে, কিপটের মত তিলে তিলে জমিয়ে রাখা অবসরের লক্ষ্মীরহাঁড়িটা আঁকড়ে ধরে। মনকে সামলাই, মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝাই যে খুব শীঘ্রই আসবে সে দিন, ফিরব যেদিন আমার চেনা শহরটায়। শীতের দুপুরে আমার মেয়ের হাত ধরে আবার হারিয়ে যাব বইপাড়ায়, হেঁটে বেড়াব আমার মেয়েবেলার গলিতে গলিতে, আমার নেশাটা ধরিয়ে দেব ওর মনেও।

 
2 টি মন্তব্য

Posted by চালু করুন সেপ্টেম্বর 29, 2015 in বিভাগবিহীন

 

2 responses to “মনের চোরা গলি

  1. Horus

    সেপ্টেম্বর 29, 2015 at 13:32

    ঠিক এই কারনেই মনে হয়, এই সময়টা আমার নয়; এই শহরটা আমার নয়। বড় অপরিচিত সব। সুধু মারমার কাটকাট অন্ধের মত দৌড়। সময় নেই, হারিয়ে যাব নেই, অলীক চিন্তায় ধুবে যাওয়া নেই – যেন জীবনটাই নিরুদ্দেশ !

     
  2. Rose Tinted Glasses

    সেপ্টেম্বর 29, 2015 at 13:45

    শহরটা এককালে আমার ছিল, সময় কোনও দিনই আমার ছিল না। সময়ের সাথে বন্ধুত্ব তাই কোনোদিন আর হল না, তাই তাল রাখতে হাঁফিয়ে যাই, পিছিয়ে পড়ি, থমকে দাঁড়াই আমার জানালার পাশে।

    ধন্যবাদ ঃ)

     

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: