RSS

চাঁপা ফুলগুলো…

29 আগস্ট

বুড়ো বৃষ্টিভেজা একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, ‘সবকো তিশ রুপয়া মে দসঠো দে রাহা হুঁ, আপ বারা লে যাও’। বলে একটা কাঁচা শালপাতায় পনেরোটা সদ্য ফোটা শীতের নরম রোদের মত কুসুম রঙ্গা ফুল মুড়ে, ভেজা সাদা সুতোর রিলটা থেকে খানিকটা সুতো দিয়ে জড়িয়ে, আমার হাতে ধরিয়ে দিলো।

‘বারা? আপনে তো পনদ্রা দিয়া?’ বুড়ো আগেও এক দিন এইরকম কাজ করেছিল, আমার দেওয়া একশো টাকা থেকে চল্লিশ টাকা কাটার কথা, ফেরত দিলো আশি টাকা। আবার তাকে প্রায় অঙ্ক কষে হিসেব মত টাকা দিয়ে এসেছিলাম।

আমার পাড়ার আকাশছোঁয়া বাড়িগুলোর গোড়ালির কাছে একটা ছোট্টো বাজার আছে। চটজলদির সব পাওয়া যায় – রোজনামচার চাল, ডাল, শাকসব্জি, ফল, মিষ্টিমন্ডা, জলখাবারের টুকিটাকি, ওষুধপত্র, খাতা পেনসিল, ফুল – খুব দরকার পড়লে বোধহয় বাঘের দুধও। তাই নানা কারণে, অকারণে ও পথে আমার যাতায়াত লেগেই থাকে।

এক এক সময় সন্ধ্যা নামার মুখে পৌঁছলে, খবরের কাগজের স্টলটার গা ঘেঁষা, নীচু চওড়া পাঁচিলটার উপর বসে থাকতে দেখি ওই ফুলওয়ালা বুড়োকে। একটা মাঝারি ঝুড়িতে মরসুমি ফুল সাজিয়ে ওই পাঁচিলের উপর বেচতে বসে। গনগনে গরমের পড়ে আসা বেলায় বেল আর জুঁইয়ের মোটা মোটা ‘গজরা’ আর ঝুরো বেল।

সেদিন, এই ঘোর বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরা সাঁঝে দেখি একটা বড় কালো ছাতার তলায় বসে আছে ফুলের ঝুড়ি নিয়ে। আমায় দেখে মুচক হেসে, হাত নেড়ে ডাকল। এগিয়ে গেলাম। ঝুড়ির একধারে বড় বড় বেলফুলের গজরা আর তার সাথে নরম, কুসুম রঙা কী জানি এক ফুল। বড় সুন্দর ‘খোশবাই’। ওটা আমার

ওটা আমার ঠাকুমার বলা কথা, নাম না জানা ফুলটার গন্ধে মনে পড়ে গেল।

‘দিদি, দেখো আজ চম্পা লায়া, বহুত বড়িয়া খুসবু হ্যায়, আপ আজ মোগরা মত লো, আপ চম্পা লে যাও’ আবদারের সুরে বলল সে। যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানকার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ভেজা বাতাস চাঁপা ফুলের গন্ধে তখন আরও ভারী হয়ে উঠছে।

champa

ইঁট বের করা, কেঠো, পলেস্তারা খসে পড়া শহরে বড় হয়েছি তো, তাই চাঁপাফুলের কথা অনেক শুনে, বইএ পড়ে চিনেছি, চোখে দেখিনি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়? কলকাতায় কিন্তু চাঁপা ফুলের গাছ আমার চোখে কোনদিন পড়েনি।

বেশ বুঝলাম চাঁপার পাগল করা মিষ্টি গন্ধটা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে, ভেসে যেতে ডাকছে। কবিরা চাঁপার সুবাস নিয়ে কেন এত উদ্বেলিত, তাও এবার বেশ বুঝলাম। তাই বুড়োর আবদার রাখলাম। সে আমায় তিরিশ টাকায় পনেরোটা ফুল দেবেই, বকে ঝকে পঁয়তিরিশ টাকা দিয়ে ফেরার পথে হাঁটা দিলাম।

আজকাল মাঝেমাঝেই সন্ধ্যার মুখোমুখি বাজারে যাই, বিনা কারণে, কখনো বৃষ্টি মাথায় করেই। ফিরে আসি এক মুঠো চাঁপা ফুল হাতে। রাতের দিকে যখন ঝেঁপে বৃষ্টি নামে, আমাদের পঁচিশ তলার বারান্দার দরজাটা খুলে, অন্ধকারে বসে থাকি দরজার সামনে। আঁধারের ওপারে আলোর মালা, অনেক নীচে বাড়িগুলোয় কমতে থাকে বাতি – আমি বসে দেখি আর গান শুনি। ভেজা হাওয়ায় টেবিলে কাঁচের রেকাবিতে রাখা চাঁপাগুলো ভাসিয়ে দেয় তাদের খোশবাই, লুটিয়ে পড়ে আমার চোখে, মুখে, চুলে। এতোদিন বাদে আলাপ তো, তাই আঁধারের আড়ালে বসে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে একটু, একটু করে গাঢ় করি, আমি আর চাঁপা ফুলগুলো।

picture courtesy : http://www.flickr.com/photos/kgabhi/5643382020/ 
 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: