RSS

শতরঞ্জ কী আনাড়ি

10 জুলাই

আমার এই সময় ব্লগ, শতরঞ্জ কে আনাড়ির পাতা থেকে ঃ

সদ্য আসন্ন হেমন্তের টুপটাপ পাতা খসানো একটা দিনে, জুরিখের ছোট্ট একটা পার্কে দাঁড়িয়েছিলাম। গেটের সামনেই মাটিতে একটা ছোট চৌকো শান বাঁধানো জায়গা, কতকাল আগেকার সাদা কালো টালি বসিয়ে দাবার ছক বানান। কাঠের ঘুঁটিগুলো বেশ সুন্দর, মাপে এক থেকে দেড় ফুট মত। বিকেলের ঢলে পড়া রোদে পিঠ দিয়ে দুই বৃদ্ধ সেই ছকের মাঝে দাঁড়িয়ে রাজা, রানী, গজ, বোড়ে নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখলাম খানিক, ছবিও তুললাম কটা।

chess players

মন গুরুগম্ভীর সুরে শুধালো, ‘শেখা হয়েছিল দাবা? ছবিগুলো ফেসবুকে লাগিয়ে কি জ্ঞান জাহির করবে শুনি?’ বাবা কিছুদিন চেষ্টা করেছিলেন বটে এবং পরবর্তী কালে আমার পতিদেবও, কিন্তু আমার বেহিসাবি মনের কাছে হার স্বীকার করতে হয়ে দুজনকেই। আমি এখনও তাই শতরঞ্জ কি আনাড়ি।

নাহ, ব্লগের নামটা আমি ধাঁ করে দিয়ে ফেলিনি। নিজেকে নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা, পড়াশোনা করে, নিজের সাথে নানা তর্ক বিতর্ক করেই এই নামে সায় দিয়েছি। মনও উপায় না দেখে, ফোঁস করে বিরাট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেনে নিয়েছে।

তো, আপনি কোন দলের, শতরঞ্জ কী আনাড়ি না খিলাড়ি? থমকে যাওয়ার কিছু নেই। এই দুটো বিশেষ্যই তো আমাদের আসল পরিচয়। একবার চেয়ে দেখুন চারিপাশে। বিশাল একটা দাবার ছকে দিন রাত আমরা যেন রাজা, রানী, মন্ত্রী, গজ, বোড়ে – এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে বসছি – কেউ ছলে, কেউ কৌশলে, কেউবা স্রেফ বুদ্ধির জোরে টপাটপ বাধা কাটিয়ে, প্রতিপক্ষের রাজাকে ধরাশায়ী করে কিস্তিমাত করছে – শুরু হচ্ছে তার নতুন ছকে নতুন প্রতিপক্ষের সাথে নতুন খেলা। আর কেউ একই ছকে, একই খেলায় বারবার হেরে, ঘুরে মরছে গোলকধাঁধায়।

আমি কেন আনাড়ি? আসলে জনসমক্ষে বুক চিতিয়ে নিজেকে উঁচু দরের খেলোয়ার জাহির করতে বেশ ভয় করে। আশেপাশে আজকাল জ্ঞানীগুণী মানুষের ভীড় ভারি। সবাই কত কিছু নিয়ে চর্চা করে, লেখালেখি গান বাজনা ফটোগ্রাফি এমনকি রান্নাবান্নাও – সবাই সর্বজ্ঞ – তর্ক বিতর্ক চলে কত রকম, চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলে তারা আরামকেদারা থেকে পৃথিবীর নানা কোণায় বিপ্লব নিয়ন্ত্রন করে। ধরুন তাদেরই মধ্যে থেকে কেউ খপ করে ধরে যদি জিজ্ঞেস করে “৬৪-র ঘরের নামতাটা বলুন দেখি, তাহলে বুঝব আপনি পাকা খেলোয়ার”। অথবা ধরুন গান শুনছি, তারই মাঝে কেউ ব্যাঘাত ঘটিয়ে বসল, “এই যে হিগস বসন নিয়ে এতো গবেষণা, সেই গড পার্টিকেল-এর হদিস পেলে কি মানুষ শেষমেষ ভগবানের দেখা পাবে?” আর এই সেদিন কি তুফান, ‘মাসলোর মানুষের চাহিদার শ্রেণীবিন্যাসের পিরামিড-এর নীচে, সব থেকে নীচু শ্রেণীর যে মানুষগুলো পিষ্ট হয়ে আছে, তারা যদি হঠাৎ সমাজের সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে তাহলে কি আসন্ন প্রজন্মেরা “চাকর” কথার মানে জানতে অভিধান খুলে বসবে?’ বা কেউ যদি চেয়ে বসে মতামত – “এন্ড্রয়েড না আই ফোন?” “ফেসবুক না টুইটার?” “ম্যান ইউ না আরসেনাল?” “কুরোসাওয়া না বার্গম্যান?” “অরহান পামুক নাকি গেব্রিয়েল মার্কেজ?”

বাতাসে বুদবুদের মত অনেক কথা, নানা তথ্য, নতুন মতবাদ আরো কত কি ভেসে বেড়াচ্ছে – কতটুকুই বা আমার নাগালের মধ্যে? ধরতে গেলে, আঙ্গুলের ছোঁয়া লেগে হাওয়ায় মিশে যায় হাওয়া হয়ে। তাই পাকা খেলোয়ার হয়ে উঠতে পারলাম না এখনো।

আমি হতে চাই একটু দলছুট। জ্ঞানীগুণীদের ভিড় এড়িয়ে, নির্নিমেষে বয়ে চলা ঐ জ্ঞানের স্রোত থেকে গা বাঁচিয়ে, পাড়ে বসে পা দোলাব, বিনি পয়সার বায়োস্কোপে দিবাস্বপ্ন দেখব। আমি আনাড়িই ভালো। বাঁধা ছকের ওপর রাজা ক’পা পিছোবে, গজ কাকে আগলাবে, রানী বাঁচাতে ক’টা বোড়ের সর্বনাশ ডেকে আনব – ওই হিসাবটা ঠিক এখনও কষে উঠতে পারিনা।

তার চেয়ে এদিক ওদিক হাঁটকে, এখানে ওখানে কান পেতে – নানা কথার পিঠে কথা গেঁথে, গল্প সাজিয়ে, আসর পেতে আড্ডা মারব, কেমন? প্যাঁচপয়জার, তর্ক বিতর্ক, জ্ঞানগম্যির নাগালের বাইরে – শতরঞ্জ কী আনাড়ির আড্ডা।

 

মন্তব্য করুন

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  পরিবর্তন )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  পরিবর্তন )

Connecting to %s

 
%d bloggers like this: