মাঝে মাঝে ভাবি। আর অবাক হই, দেশটা কি ছাগলে ভরে গেল? না, না। একটু মন দিয়ে পড়ুন, আপনিও আমার কথার মানেটা ধরতে পারবেন।
আমার মনও সেদিন না বুঝে আঁতকে উঠেছিল, ‘সে কি? বেশ তো দু’পাওয়ালা মানুষগুলো হেঁটে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে, টিভি, সিনেমা, ফেসবুক, টুইটার নিয়ে মেতে আছে, মাঝেমাঝে একটা আধটা বইও পড়ছে – এর মাঝে তুমি ছাগল দেখলে কোথায়ে? অনেক হয়েছে, এবার তোমার ওই খেয়ালে, খেয়ালে বিচরণ করাটা ছাড়ো, লেখায় মন দাও।’
এহেন মনকে বোঝাতে বসলাম। দেশ ভরেছে দু’পেয়ে ছাগলে। নাহলে টিভিতে দিন রাত শাশুড়ি-বউএর প্যানপ্যানানি, রদ্দি মার্কা লেখা গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজের কলম, শস্তা, চটুল গানের কলি, বস্তাপচা ফর্মুলায় ঢালা সিনেমা – এসবে বাজার ছেয়ে গেছে? আর এই দু’পেয়ে মানুষরূপী ছাগলের দল তাই তারিয়ে তারিয়ে চিবোচ্ছে?
মন বলল, ‘ইস, আস্তে! পাবলিককে ছাগল বললে? পাবলিক তো তোমার ব্লগও পড়ে। তারা রেগে যাবে!’
আমার মত হল, গানের কলি যদি হয় ‘ভাগ, ভাগ ডি কে বোস’; ‘বাপি, বাড়ি যা’ – পারিবারিক সংবাদ পত্রের, ম্যাগাজিনের ছত্রে ছত্রে যদি শুধু থাকে স্বল্পবাসিনি সুন্দরীদের ছবি – আর যদি ‘পাবলিক’ যদি তাই বিনা প্রতিবাদে, হাপুস-হুপুস শব্দে খায়ে, তাহলে আমার পাবলিককে ‘ছাগল’ বলাটা কি অন্যায়?
এই সেদিনকার কথা। একটা নতুন বই পড়তে শুরু করেছি। লেখক গত দুই দশক ধরে ভালো ভালো কিছু বই লিখে নামডাক করেছেন। ওনার লেখা পড়তে আমার বেশ ভালই লাগে। লেখনীতে একটা স্বচ্ছতা আছে আর ওই ইংরাজিতে যাকে বলে ‘ক্লিন ফীল’ – তাও আছে। নতুন বইএর প্রথম চ্যাপ্টার শেষ করে সবে দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে ঢুকেছি, প্রেমিক-প্রেমিকা সবে চোখে চোখে প্রেমে পড়ছে – তৃতীয় প্যারাগ্রাফেই সেই চোখে চোখে প্রেম হঠাৎ একলাফে দেখি বিছানায় পৌঁছে গেল – বিনা বাক্য ব্যয়! বিনা কোনও কারণে! বইটা শেষ অবধি পড়েছিলাম, প্রিয় লেখকদের একজন বলে।
পরে জানলাম এক গুঢ় সত্য। ‘ব্যবসা করে তো খেতে হবে, আমাকেও, লেখককেও, পাবলিশারকেও, ফিল্মস্টারকেও, ফিল্ম ডাইরেক্টরকেও, নায়কেও, নায়িকাকেও – এমনকি খবরের কাগজগুলোকেও! তাই পাবলিক যা খেতে ভালবাসে আমরা তাই খাওয়াই। টি আর পি, বেস্ট সেলার লিস্ট, সুপারহিট কথাগুলো তো আর এমনি উঠে আসেনি, পাবলিক যা কিনছে, দেখছে, ভালবাসছে – সেটাই ট্রেন্ড আর তাতেই প্রফিট। পাবলিককে অবজ্ঞা করে কে কবে লাভ করেছে?’ – কার থেকে? তা নাই বা বললাম।
মন মাথা নেড়ে, চুক্ চুক্ করে বলল, ‘আর এই পাবলিকই একদিন সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল, বিমল, বুদ্ধদেব, হৃষীকেশে মজেছিল? আজ কি হল? খিদে বদলে গেল? কেন?’
আসলে মুশকিল কি জানেন? ব্যবসা। আর ব্যবসা দেবে কে? ওই গড্ডালিকা প্রবাহ। তাই ওই গড্ডালিকা প্রবাহ যাতে খিদে, পাবলিক যা ‘খাবে’, ব্যবসায়িরাও তাই বেচবে। তাই যেই ব্যবসায়ীদের বোধোদয় হয়েছে যে পাবলিকের ‘সেক্সের’ খিদেটাই সব থেকে অদম্য, ব্যাস্! গান, গল্প, নাটক, নভেল, খবরের কাগজ, ব্লগ – মায় ডিওডোরেন্ট, মোবাইল, ঘড়ি, সানগ্লাস পর্যন্ত – সব কিছু বেচতেই একই মশলা, সেক্স আর মন উস্কে দেওয়া সুড়সুড়ি।
নতুন যারা ব্যবসায় নেমেছে – ধরুন নতুন বই লিখেছে – সে জানে ‘বই বেচতে কয়েকটা সাহসী চ্যাপ্টার না লিখলে যে বই বিক্রি হয় না’ – পাবলিশার বলেছে। যে নতুন নায়ক বা নায়িকা, সেও তো লজ্জার তোয়ালে খসিয়ে না নাচলে তার ছবি দেখতে কেউ যাবে না – ডাইরেক্টার, প্রোডিউসার বলেছে। আর এদের দোষ দিয়ে লাভ কি? পাবলিক খাচ্ছে যে!
একটা সময় হয়তো ছিল যখন লেখক-লেখিকারা, সিনেমাওয়ালারা পাবলিকের মান উন্নত রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু, অনেক দিন হয়ে গেল এই ‘আঁতেল পোষণে’ আর কেউ পয়সা ঢালেনা। দলে, দলে ছাগল যখন স্বেচ্ছায় পয়সা ফেলে, সিটি মেরে যত্তসব রাবিশ গিলছে, তখন কতিপয় আঁতেলের গা জ্বলানো ন্যাকামি আর সূক্ষ্ম, চুলচেরা বিচার দিয়ে কি হবে?
বরং, প্রবীনবর, আপনি দূরে দাঁড়িয়ে ‘হায়, হা হতোস্মি’ না করে, আসুন এই নবীন সেক্সসেলারদের ভিড়ে ভিরে পরুন। তারপর? তারপর সামনে অপার সম্ভাবনা – কালজয়ী নাটক, নভেল, লিটফেস্ট, ফিল্মফেস্ট, বলিউড, হলিউড! তবে সব কিছুর আগে ছাগল ভোজন। ওইখানেতেই শুরু, কেননা, ছাগলে কি না খায়?
Picture courtesy ; bestclipartblog.com
Aniruddha
এপ্রিল 10, 2012 at 17:30
ছাগলের ব্যাপারে আপনার অগাধ পান্ডিত্যের সামনে কুর্নিশ! এর আগেও একটু অন্য জাতের ছাগল নিয়ে লিখেছেন — তাতেও মন্তব্য করেছিলাম মনে পড়ে৷ বর্তমান রচনার বিষয়ের সঙ্গে এক মত এবং আপনার বাচনরসে আমি রসমুগ্ধ৷
তবে, “… পাবলিকই একদিন সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল, বিমল, বুদ্ধদেব, হৃষীকেশে মজেছিল”, আপনার এই বাক্যটির বিরুদ্ধে আমার বলার আছে অনেক৷ সত্যজিৎ অবশ্যই; বসু হলে বুদ্ধদেবও চলবে; গঙ্গা আর দুই অরণ্যের সমরেশ বসু সত্যিই দারুণ, মজুমদার অপাংক্তেয়; সুনীলের সু-গবেষিত উপন্যাস নিশ্চয়ই সুখপাঠ্য তবে যত দিন যাচ্ছে তত কম রসোত্তীর্ণ, আর কবিতায় শক্তির ধারে-কাছে নন সুনীল৷
অবশ্যই এসব ব্যক্তি রুচির ব্যাপার, চাপিয়ে দেবার মতলব নেই আমার৷ বুদ্ধদেব গুহ ক্ষমতাবান চার্টার্ড হৈসাবিক (sic) ও কাহিনিকার তবে গঙ্গার সমরেশের সঙ্গে একাসনে বসানতেই আপত্তি শুধু, যেমন আপত্তি সত্যজিৎ আর হৃষিকেশের সমীকরণে৷ আনন্দদায়ক শিল্পও হামেশাই চারু শিল্পের সঙ্গে পাল্লা দেয়; দেবেই তো, দেওয়াই উচিত! তা নিয়ে কোন্দল করছিনা, স্বমত ব্যক্ত করছি শুধু৷
দারুণ আর জঘন্যের মধ্যে ছাই রঙের নানান শেড!