“রাজার হয়েছে এক অদৃশ্য, দুরারোগ্য ব্যাধি – রাজার খেয়ে সুখ নেই, শুয়ে সুখ নেই, রাজকার্যে মন নেই – তিনি খালি আকাশ পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ‘ফোঁস’ করেন আর বলেন ‘হায়’ – ঠোঁটে হাসিও নেই, মুখে কথাও নেই – শুধু শূন্য দৃষ্টিতে কি যেন খুঁজে ফেরেন – রাজবদ্যি নাড়ি দেখে, মাথা নেড়ে বিধান দিলেন – ‘কঠিন ব্যারাম, এ হল ‘অ-সুখ’’’।
পথে, প্রবাসে, যখনই পুরনো আত্মীয়, নতুন বন্ধু, প্রতিবেশী যাদের সঙ্গেই দেখা হোক বা কথা হোক, এক গাল হেসে প্রশ্ন করি “কেমন আছো?”, বেশির ভাগ সময়েই বিরস বদনে, শুষ্কং কাষ্ঠং উত্তর আসে “এই তো চলে যাচ্ছে”। কতিপয় আবার “এই চলে যাচ্ছে”-র পর আর থামতে চায় না। লম্বা লিস্ট নিয়ে শুরু হয়ে যায় – কে কত দুঃখে আছে তার ফিরিস্তি দিতে। নানা সমস্যা – রোগ, শোক, ব্যথা বেদনা, ব্যর্থ প্রেম, ভাড়াটে সমস্যা, বাড়িওয়ালার উৎপাত, শেয়ার বাজারের নাগরদোলা, আলু পটলের অগ্নিমূল্য, ই এম আইয়ের তাড়না, বাচ্চার পড়াশোনা, মেয়ের চাকরি, ছেলের বিয়ে, সোনার ভরি, অফিসে প্রমোশন নিয়ে কার্পণ্য, হাই প্রেশার, ব্লাড সুগার, হাইপার টেনশন– নানান মাথাব্যথা।
মন মাঝখান থেকে মনে মনে ফোড়ন কাটে ‘মাথা থাকলেই মাথাব্যাথাও থাকবে’। আমিও শুকনো হেসে মাথা নাড়ি আর মনকে বোঝাই যে পরেরবার প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করব। আশা রাখি দু’টি কথার, ‘ভাল আছি’।
কিন্তু পরের বারও আবার সেই “ভাল আছি আর বলা যাবে না, শরীর গতিক ভাল নয়”; যুবতী বলে, “ছেলে মেয়েদের মানুষ করতে করতেই জীবন শেষ হতে চলল”; স্বচ্ছল বলে, “দু’জন রোজগার করেও আজ অব্দি হ্যান্ড টু মাউথ, ই এম আই-এর চাপে চ্যাপ্টা”; হেড অফিসের বড় বাবু বলেন “প্রমোশন দেওয়ার নাম নেই”; এমনকি তন্বীও বলে “উফ, এত মোটা হয়ে গেছি, আর পারছি না”; জড়োয়ার নেকলেস গলায় গিন্নি বলেন “এত বয়স হল, হিরের নেকলেস পড়া হল না”; টাক পড়া পঞ্চাশোর্ধ কর্তা তখন ‘ফোঁস’ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সুন্দরীর ‘স্ট্যাটিস্টিক্স’ জরিপে মজে যান।
মন বলে ‘কেন রে বাবা এত হতাশা, বেশ তো সুস্থ সবল দেখাচ্ছে, রোজগার পাতিও তো যতদূর জানি কম হয় না, মা ষষ্ঠীর দয়ায় ছেলেপুলে নিয়ে ভরভরন্ত সংসার তাহলে এত দুঃখ কিসের?’ কিন্তু, এসব কি আসলে দুঃখ? নাহ! একদম নয়। এ হল ‘অ-সুখ’। নাই “সুখ”, তাই “অ-সুখ”| সুখ খুঁজে মরছি অহরহ, কিন্তু সে মরীচিকা হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় দিগন্তে। সুখ সোনার হরিণ, “তারি নাগাল পেলে, পালায় ফেলে, লাগায় চোখে ধাঁধাঁ”।
মন প্রশ্ন করেই চলে ‘সুখ কি তবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পগারপার? কেউ কি সুখি নয়? দুটো কথা ‘ভাল আছি’ – বলতে এত কুণ্ঠা কিসের?’
“সুখ? সে কি আর এ জীবনে পাব?” এক সুখ-সন্ধানি প্রশ্ন করেছিল। আমার উত্তরটা মনঃপুত হবে না জেনে তাই সেদিনও মাথা নেড়ে সেরেছিলাম। এমন সব হেঁয়ালি কি আর নিতান্তই সোজা প্রশ্নের উত্তর হতে পারে?
কিন্তু পরে ভেবে দেখলাম, এইরকম সব ভয়ঙ্কর হেঁয়ালিই এখন আমাদের সদা ব্যস্তময় জীবনটাকে আরেকটু ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। হেঁয়ালির জবাব খুঁজি টিভির পর্দায়, সিরিয়ালে সিরিয়ালে, রিয়্যালিটি শো’তে, বিজ্ঞাপনের রামধনুতে। গাল ভরা সব নাম, “মার্সিডিস, বি-এম-ডব্লু, লুই ভ্যিঁত, হার্মিস বার্কিন, রবের্তো কাভালি, আই পড, আই প্যাড, ব্ল্যাকবেরি, আর্মানি, ঋতু বেরি, সোনি ব্রাভিয়া, আইফেল, বার্সিলোনা, ম্যাটাডর, লাস ভেগাস” ইত্যাদি – মনে হয় তাই বুঝি সুখের ঠিকানা। স্বপ্নের সঙ্গে মিলে গেলে, মনের মত সব পেলেই বুঝি সুখ মেলে, না পেলেই ফক্কা – তখনই ‘অ-সুখ’। যে ধনী, যার খাওয়া পরার চিন্তা নেই, সে চায় আরও ধনী হতে| যে মানুষ দিন আনে দিন খায়, সেও চায় আকাশের চাঁদ, ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল, সিনেমায় দেখা ‘হিরো-হিরোয়িনের’-র মত জামা কাপড়, সিরিয়ালের শাশুড়ি বউ-এর মত গয়নাগাটি, পারলে একটা ন্যানো গাড়ি। গ্রাম, গঞ্জ শহর দেশ ছেড়ে এই যে পালে পালে লোক দেশান্তরী, তাও সেই সুখেরই খোঁজে।
আর কারো কথা বলে লাভ কি? আজকাল নিজেরই রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়ে, ‘উফ, আর কি পেলে মনটা বেশ খুশি থাকবে আর আমারও মনে হবে আমি সুখী?’ যেই ভাবি ‘ভালোই তো আছি’, মনে প্রশ্ন জাগে ‘সত্যি কি ভালো আছি?’। ম্যাগাজিনের পাতায় পাতায় খুঁজি সুখী গৃহ কোণের ছবি, নিজের ঘরের কোণা মেলাতে চাই সেই রঙে, স্বপ্নের আসবাবে, উড়িয়ে দিতে চাই রেশমি আঁচল, উড়ে যেতে চাই স্বপ্নের রাজপুত্তুরের সঙ্গে সাত সাগর আর তেরো নদীর পাড়ে| হ্যাঁ, আজকাল মাঝেমাঝে এই ‘অ-সুখ’ অসুখটা আমারও হয়।
“দুঃখ কিসে যায়? / প্রাসাদেতে বন্দি রওয়া বড় দায় / একবার ত্যাগিয়া সোনার গদি / রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায় / তবে রাজা শান্তি পায়”